বিশ্বজুড়ে ৪০ হাজার সিকিউরিটি ক্যামেরা অরক্ষিত, সতর্ক করলো গবেষকরা

বাড়ি থেকে শুরু করে হাসপাতাল, অফিস, দোকান—সর্বত্রই এখন নিরাপত্তার জন্য সিসিটিভি ক্যামেরা অপরিহার্য। চোর-ডাকাত রুখতে, দুর্ঘটনা রেকর্ড করতে অথবা যেকোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা পর্যবেক্ষণে এই ক্যামেরাগুলো আমাদের আস্থা জোগায়। কিন্তু বিশ্বখ্যাত সাইবার নিরাপত্তা গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিটসাইটের এক চাঞ্চল্যকর প্রতিবেদন বলছে, এই আস্থা এখন পরিণত হয়েছে এক ভয়াবহ গোপন নজরদারির ফাঁদে। বিশ্বজুড়ে ৪০ হাজারেরও বেশি সিকিউরিটি ক্যামেরা এখন অনলাইনে অরক্ষিতভাবে সম্প্রচার হচ্ছে, যা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে করে তুলেছে ‘পাবলিক শো’!

পাসওয়ার্ডবিহীন গোপনীয়তার বিড়ম্বনা

বিটসাইটের রিপোর্ট অনুযায়ী, এই বিপুল সংখ্যক ক্যামেরা এমনভাবে অনলাইনে সংযুক্ত রয়েছে যে, কোনো পাসওয়ার্ড, এনক্রিপশন বা নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছাড়াই যেকোনো ব্যক্তি চাইলেই সেগুলোর লাইভ ফিড দেখতে পাচ্ছে। সিসিটিভি, ওয়েবক্যাম, বেবি মনিটর এমনকি অফিসের নজরদারি ক্যামেরাও এর অন্তর্ভুক্ত। ক্লাউড স্টোরেজ, রিমোট অ্যাক্সেস, এবং মোবাইল অ্যাপে সরাসরি ভিডিও দেখার সুবিধার কারণে ক্যামেরাগুলো এখন ক্রমশ ইন্টারনেট-নির্ভর হয়ে পড়ছে।

কিন্তু সমস্যার মূলে রয়েছে এই সংযুক্তির পেছনে নিরাপত্তার গুরুতর অভাব। অনেক ব্যবহারকারীই ক্যামেরা সেটআপের সময় দেওয়া ‘ডিফল্ট পাসওয়ার্ড’ পরিবর্তন করেন না। আবার কিছু ক্যামেরা এমনভাবে ডিজাইন করা যে, সেগুলোর অ্যাপ্লিকেশন প্রোগ্রামিং ইন্টারফেস (API) প্রকাশ্যে থাকে। ফলে, যদি কোনো হ্যাকার নির্দিষ্ট লিংকটি জেনে যায়, তবে সে সহজেই পাসওয়ার্ড ছাড়াই ভিডিও ফিড দেখতে পারে।

কোথায় ঘটছে এই গোপন নজরদারি?

বিটসাইট জানিয়েছে, বিশ্বব্যাপী ৪০ হাজারেরও বেশি ক্যামেরা অনলাইনে উন্মুক্ত। এর মধ্যে প্রায় ১৪,০০০ ক্যামেরা রয়েছে শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই। এরপরেই তালিকায় আছে জাপান, অস্ট্রিয়া, চেক প্রজাতন্ত্র, দক্ষিণ কোরিয়া এবং অন্যান্য দেশ। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া ও টেক্সাস অঙ্গরাজ্যে সবচেয়ে বেশি অরক্ষিত ক্যামেরা দেখা গেছে।

সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো, এই ক্যামেরাগুলোর অধিকাংশই স্থাপন করা হয়েছে হাসপাতাল, এটিএম বুথ, কারখানা, স্কুল, এমনকি শিশুদের নার্সারিতে! বহু ব্যক্তিগত বাসা বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে স্থাপিত ক্যামেরার ব্যবহারকারীরা নিজের অজান্তেই তাদের ব্যক্তিগত জীবন বিশ্বজুড়ে সম্প্রচার করছেন।

অরক্ষিত ক্যামেরার ফাঁদ: হ্যাকারদের সহজ লক্ষ্য

বিশ্লেষণ বলছে, অরক্ষিত সিকিউরিটি ক্যামেরাগুলোর প্রধান সমস্যাগুলো হলো:

  • ডিফল্ট পাসওয়ার্ড: অনেক ব্যবহারকারী ক্যামেরা সেটআপের সময় দেওয়া ডিফল্ট পাসওয়ার্ড পরিবর্তন করেন না।
  • খোলা API: ক্যামেরা নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের ডেভেলপার লিংক বা API প্রকাশ্যে থাকলে ভিডিও ফিডে সহজেই প্রবেশ করা যায়।
  • পুরোনো ফার্মওয়্যার: নিয়মিত আপডেট না করায় ক্যামেরা সফটওয়্যার দুর্বল হয়ে পড়ে, যা হ্যাকারদের জন্য সুযোগ তৈরি করে।
  • সার্চ ইঞ্জিন হ্যাকারদের সহায়ক: Shodan.io-এর মতো বিশেষায়িত সার্চ ইঞ্জিন হ্যাকারদের জন্য এসব অনিরাপদ ক্যামেরা সহজেই শনাক্ত করে দেয়।

সাইবার অপরাধীরা এই অরক্ষিত ক্যামেরার ভিডিও ফিড ব্যবহার করে বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কাজ করছে। এর মধ্যে রয়েছে বাসা বা প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে গোয়েন্দাগিরি, এটিএম বা পস মেশিনের পিন কোড চুরি, গুদাম বা স্টোর রুমের চিত্র দেখে চুরি পরিকল্পনা, বেবি মনিটর হ্যাক করে পরিবারের উপর মানসিক চাপ সৃষ্টি, এবং সংস্থার ভেতরের তথ্য ও নথিপত্র শনাক্ত করা।

ডার্ক ওয়েবে ক্যামেরা অ্যাক্সেস বিক্রি: এক ভয়ঙ্কর বাস্তবতা!

সাইবারনিউজ এবং বিটসাইট-এর রিপোর্টে উঠে এসেছে আরও ভয়ঙ্কর এক তথ্য—ডার্ক ওয়েবের হ্যাকার ফোরামগুলোতে এই ক্যামেরার তথ্য ও লিংক প্রকাশ্যেই টাকার বিনিময়ে বিক্রি হচ্ছে! শুধু তাই নয়, এই প্ল্যাটফর্মগুলোতে রয়েছে সুনির্দিষ্ট গাইডলাইন, যেখানে ধাপে ধাপে শেখানো হচ্ছে কীভাবে এমন অরক্ষিত ক্যামেরা খুঁজে বের করে হ্যাক করতে হয়। এটি সাইবার নিরাপত্তার এক নতুন এবং বিপজ্জনক দিক উন্মোচন করেছে।

আপনার ক্যামেরা সুরক্ষিত রাখতে যা করবেন:

বিশেষজ্ঞরা এই পরিস্থিতি থেকে নিজেদের রক্ষা করার জন্য নিম্নোক্ত সতর্কতা ও ব্যবস্থা গ্রহণের পরামর্শ দিচ্ছেন:

  • ডিফল্ট পাসওয়ার্ড অবিলম্বে পরিবর্তন করুন: ক্যামেরা সেটআপ করার পরপরই ডিফল্ট পাসওয়ার্ড পরিবর্তন করে একটি শক্তিশালী এবং জটিল পাসওয়ার্ড ব্যবহার করুন।
  • কমপ্লেক্স ও শক্তিশালী পাসওয়ার্ড ব্যবহার করুন: বড় হাতের ও ছোট হাতের অক্ষর, সংখ্যা এবং বিশেষ অক্ষরের সমন্বয়ে তৈরি পাসওয়ার্ড ব্যবহার করুন।
  • ফার্মওয়্যার ও সফটওয়্যার নিয়মিত আপডেট করুন: ক্যামেরা নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট থেকে নিয়মিত ফার্মওয়্যার ও সফটওয়্যার আপডেট করুন।
  • ওয়াই-ফাই এনক্রিপশন নিশ্চিত করুন (WPA3 হলে ভালো): আপনার ওয়াই-ফাই নেটওয়ার্ক সুরক্ষিত রাখুন। WPA3 এনক্রিপশন ব্যবহার করলে নিরাপত্তা আরও বাড়বে।
  • প্রয়োজন না হলে ইন্টারনেট থেকে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করুন: যখন ক্যামেরার রিমোট অ্যাক্সেসের প্রয়োজন নেই, তখন ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে রাখুন।
  • নিজের ক্যামেরা কোথায় সম্প্রচার করছে তা সময় সময় চেক করুন: Shodan.io-এর মতো প্ল্যাটফর্মে নিজের আইপি অ্যাড্রেস বা ক্যামেরার মডেল দিয়ে অনুসন্ধান করে দেখুন আপনার ক্যামেরা অনলাইনে উন্মুক্ত আছে কিনা।
  • বিশেষজ্ঞ পরামর্শ নিয়ে নিরাপত্তা নিশ্চিত করুন: প্রয়োজনে সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের সাহায্য নিন।

স্মার্ট হোম, স্মার্ট অফিস, স্মার্ট শহরের ভিড়ে ‘স্মার্ট নিরাপত্তা’ নিশ্চিত না করতে পারলে, এই প্রযুক্তিই হয়ে উঠতে পারে ‘বড় বিপদ’। একদিকে প্রযুক্তি যেমন আমাদের জীবন সহজ করছে, অন্যদিকে সচেতন না হলে এটি আমাদের গোপনীয়তা হরণ এবং নিরাপত্তা ঝুঁকিতে ফেলতে পারে।

Related Posts

© 2025 Tech Informetix - WordPress Theme by WPEnjoy