বিশেষ: ৭ হাজার বছর পর প্রাণ ফিরে পেল বাল্টিকের প্রাচীন শৈবাল, জেনেনিন কী বলছে বিজ্ঞানীরা?

আলো ও অক্সিজেনবিহীন পরিবেশে প্রায় সাত হাজার বছর বাল্টিক সাগরের কাদার গভীরে ঘুমিয়ে থাকার পর ক্ষুদ্র আকারের বিভিন্ন শৈবাল আবারও প্রাণ ফিরে পেয়েছে। সাম্প্রতিক এক গবেষণা এই বিস্ময়কর তথ্য প্রকাশ করেছে।

গবেষণায় দেখা গেছে, ‘স্কেলেটোনেমা ম্যারিনোই’ নামের প্রাচীন প্রজাতির একটি শৈবাল দীর্ঘ সহস্রাব্দ ধরে সুপ্ত অবস্থায় বেঁচে থাকতে পারে এবং এখনও তাদের আধুনিক উত্তরসূরিদের মতোই বেড়ে উঠতে ও সালোকসংশ্লেষণ করতে সক্ষম।

এই গবেষণার নেতৃত্ব দিয়েছে জার্মানির ‘লিবনিজ ইনস্টিটিউট ফর বাল্টিক সি রিসার্চ ওয়ার্নমুন্ডে’ (আইওডাব্লু)-এর বিজ্ঞানীরা। ‘ফাইটোয়ার্ক’ নামক একটি বৃহৎ গবেষণা প্রকল্পের অংশ হিসেবে এই কাজটি সম্পন্ন হয়েছে। ‘ফাইটোয়ার্ক’ প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য হলো বাল্টিক সাগরের অতীতের ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটন জীববৈচিত্র্যের ধরন, বাস্তুতন্ত্রের কার্যকারিতা এবং সময়ের সাথে সাথে এর পরিবর্তনের ইতিহাস অনুমান ও গবেষণা করা। এই গবেষণার প্রধান লক্ষ্য হলো বর্তমান ও ভবিষ্যতের পরিবেশগত পরিবর্তন সমুদ্রকে কীভাবে প্রভাবিত করতে পারে তা বোঝা।

বিজ্ঞানভিত্তিক ওয়েবসাইট নোরিজের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্যাকটেরিয়া থেকে শুরু করে উদ্ভিদ ও প্রাণী পর্যন্ত অনেক জীবন্ত প্রাণী যখন বেঁচে থাকার জন্য অনুকূল পরিবেশ পায় না, তখন তারা সুপ্তাবস্থা নামক ‘স্লিপ মোডে’ চলে যেতে পারে। এই সময় তারা নিজেদের বিপাক প্রক্রিয়াকে ধীর করে দেয় এবং ভালো সময়ের জন্য অপেক্ষা করে। ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটনও এই ধরনের জীবের মধ্যে অন্যতম। পানিতে বসবাসের সময় যখন তাদের বেঁচে থাকার মতো কঠিন পরিস্থিতি তৈরি হয়, তখন তারা বিশ্রামের জন্য একটি কঠিন স্তর তৈরি করে। এ সময় তারা পানির নিচে ডুবে যায় এবং শতাব্দী, এমনকি হাজার বছর ধরে সমুদ্রের গভীরে কাদায় সংরক্ষিত থাকতে পারে, বিশেষ করে অক্সিজেনবিহীন অঞ্চলে।

এই গবেষণার প্রধান বিজ্ঞানী সারাহ বলিউস বলেছেন, “এসব পলি অনেকটা টাইম ক্যাপসুলের মতো। এগুলোতে কেবল পুরনো কোষই নয়, বরং ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে পরিবেশগত পরিস্থিতি যেমন লবণাক্ততা, তাপমাত্রা ও অক্সিজেনের মাত্রা সম্পর্কেও মূল্যবান তথ্য সংরক্ষিত থাকে।”

গবেষকরা এই গবেষণার জন্য বাল্টিক সাগরের ‘ইস্টার্ন গটল্যান্ড ডিপ’ নামক একটি এলাকা থেকে ২৪০ মিটার গভীর সমুদ্রের তলদেশ থেকে কাদার নমুনা সংগ্রহ করেছিলেন। পলির এই স্তরগুলো বাল্টিক সাগরের প্রায় সাত হাজার বছরের ইতিহাস ধারণ করে। বিজ্ঞানীরা এই স্তরগুলোর মধ্যে নয়টি স্তর থেকে পুরনো শৈবালকে পুষ্টি ও আলো সরবরাহ করে ‘জাগিয়ে তুলতে’ সক্ষম হয়েছেন। পুনরুজ্জীবিত এই শৈবালগুলো তাদের আধুনিক প্রজাতির শৈবালের মতোই বেড়ে উঠেছে, কোষ বিভাজন ঘটিয়েছে এবং এমনকি সালোকসংশ্লেষণও করেছে।

বিস্ময়করভাবে, এই প্রাচীন শৈবালগুলো প্রায় ছয় হাজার আটশ ৭১ বছর বয়সী হওয়া সত্ত্বেও এখনও বেশ সতেজ অবস্থায় রয়েছে। তারা আধুনিক প্রজাতির শৈবালের মতোই একই হারে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং একই স্তরে সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে অক্সিজেন তৈরি করেছে, যা ইঙ্গিত দেয় যে তারা এখনও সম্পূর্ণরূপে কার্যকর।

গবেষণা দলটি পুনরুজ্জীবিত বিভিন্ন শৈবালের ডিএনএ নিয়েও গবেষণা করেছে এবং জিনগত উপাদানের ছোট নমুনার সাথে তাদের তুলনা করেছে। গবেষকরা বিভিন্ন সময়কালের শৈবালের মধ্যে স্পষ্ট জিনগত পার্থক্য খুঁজে পেয়েছেন। তারা বলছেন, এর মাধ্যমে সহস্রাব্দ ধরে এই প্রজাতিগুলো কীভাবে বিবর্তিত হয়েছে, তারই ইঙ্গিত পাওয়া যায়। এই গবেষণা আরও নিশ্চিত করেছে যে গবেষণাগারে কাজ করার সময় এই শৈবালের নমুনাগুলো দূষিত ছিল না।

এই ধরনের গবেষণা ‘পুনরুত্থান বাস্তুবিদ্যা’ নামে পরিচিত, যেখানে প্রাচীন জীববৈচিত্র্যকে ফিরিয়ে আনার মাধ্যমে তারা কীভাবে পরিবর্তিত হয়েছে, তা নিয়ে গবেষণা করা হয়। গবেষকরা বলছেন, এত পুরনো শৈবালকে পুনরুজ্জীবিত করার ক্ষেত্রে সফলতা পাওয়ার ঘটনা খুবই বিরল।