বাংলাদেশে হিন্দু সন্ন্যাসী চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে গ্রেপ্তার করার পরই তার সঙ্গে যে হিন্দু ধর্মীয় সংগঠনের যোগ ছিল, সেই ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি ফর কৃষ্ণ কনশাসনেস বা আন্তর্জাতিক কৃষ্ণ ভাবনামৃত সংঘকে (ইসকন) নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। ইসকন উগ্র ধর্মীয় মতবাদ প্রচার করে বলেও অভিযোগ তুলছেন অনেকে।
আবার এর আগে ইসকনকে যেসব দেশে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল, সেই সব তথ্যও তুলে ধরে বাংলাদেশেও সংগঠনটিকে নিষিদ্ধ করার দাবি তোলা হচ্ছে সামাজিক মাধ্যমে। যদিও বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ হাইকোর্ট ইসকনকে নিষিদ্ধ করার আবেদন আমলে নেয়নি।
আবার ইসকন আসলেই হিন্দু ধর্ম প্রচার করে কি না, তা নিয়েও বিতর্ক নজরে আসে ইন্টারনেট ঘাঁটলেই। এই প্রতিবেদনে ইসকন আসলে কী কাজ করে, সেই বিষয়ে আলোকপাত করার চেষ্টা করা হবে।
• ইসকনের জন্ম
দক্ষিণ কলকাতার টালিগঞ্জ অঞ্চলে জন্ম নেওয়া অভয়াচরন দে পরবর্তী জীবনে অভয়া চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ বা এসি ভক্তিবেদান্ত ইসকনের প্রতিষ্ঠাতা। তাকেই ধর্মগুরু বলে মানেন সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা ইসকনের লাখো ভক্ত।
কলকাতায় ইসকনের ভাইস প্রেসিডেন্ট ও মুখপাত্র রাধারমণ দাস বলেন, তিনি কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজে পড়াশোনা করেছেন। স্বাধীনতা সংগ্রামেও অংশ নিয়েছেন। অনেক বেশি বয়সে তিনি এই কলকাতাতেই তার গুরু মহারাজের দেখা পান। তিনিই এসি ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদকে আদেশ দেন যে পশ্চিমী দেশগুলাতে গিয়ে হিন্দু ধর্মের প্রচার চালাতে। তার যখন প্রায় ৭০ বছর বয়স, সেই সময়ে তিনি একটি মালবাহী জাহাজে চেপে কলকাতা থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে পৌঁছান। সেটা ছিল ১৯৬৫ সালের ১৬ জুলাই।
ইসকনের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রে রওনা হওয়ার সময়ে এসি ভক্তিবেদান্ত স্বামীর সঙ্গে মাত্র কয়েক ট্রাঙ্ক ভর্তি বই এবং মাত্র সাত মার্কিন ডলার ছিল। ইসকনের প্রতিষ্ঠা হয় ১৯৬৬ সালে আর এসি ভক্তিবেদান্তের মৃত্যু হয় ১৯৭৭ সালে।
এই অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি বিশ্বের বহু দেশে গিয়েছেন, ৪০টির বেশি গ্রন্থ রচনা করেছেন। বর্তমানে পাঁচ শতাধিক বৃহৎ কেন্দ্র, এর বাইরেও বহু মন্দির, স্কুল, কয়েক হাজার স্থানীয় গোষ্ঠী, প্রায় একশো নিরামিষ রেস্তোরাঁ পরিচালনা করে থাকে ইসকন। এছাড়াও নানা সমাজকল্যামূলক কাজ, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ত্রাণ বিলি করে থাকে তারা।
এই সংঘের প্রধান কেন্দ্র পশ্চিমবঙ্গের নদীয়ার মায়াপুরে। সংঘটি দাবি করে, এই মায়াপুরেই জন্ম গ্রহণ করেছিলেন বৈষ্ণব সন্ন্যাসী চৈতন্যদেব।
• গৌড়ীয় বৈষ্ণব মতবাদ প্রচার
ইসকন দাবি করে, তাদের আধ্যাত্মিক মতাদর্শের ভিত্তি হলো সংস্কৃতে রচিত ভগবৎ গীতা এবং ভগবৎ পুরাণ। রাধারমণ দাস বলছিলেন, আমরা গৌড়ীয় ব্রহ্ম মাধব সম্প্রদায়। ইসকনের ভাবাদর্শ হলো এই বাংলার যে বৈষ্ণব মতবাদ, অর্থাৎ গৌড় অঞ্চলের বৈষ্ণব ধারা, সেটাই আমরা বিশ্বে ছড়িয়ে দিই।
ইসকন সদস্যরা নিজস্ব মন্দিরগুলোতে পুজার বাইরেও নানাভাবে নিজেদের মতাদর্শ ছড়িয়ে দিয়ে থাকেন। রাস্তায় খোল-করতাল নিয়ে ‘হরে কৃষ্ণ হরে রাম’ মন্ত্র পাঠ করে নেচে অথবা সেমিনারসহ নানাভাবে তারা ইসকনের মতবাদ প্রচার করেন বিশ্বজুড়ে।
• হিন্দু ধর্মেরই অঙ্গ ইসকন
ইসকন যে গৌড়ীয় বৈষ্ণব মতবাদ প্রচার করে তা আদৌ হিন্দু ধর্ম কি না, তা নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তোলেন। পশ্চিমবঙ্গ বৈদিক অ্যাকাডেমির প্রধান নবকুমার ভট্টাচার্য ব্যাখ্যা করছিলেন, হিন্দু ধর্মে যে পাঁচটি সম্প্রদায় রয়েছে, তারই অন্যতম বৈষ্ণব সম্প্রদায়। অন্য সম্প্রদায়গুলো হলো শৈব, শাক্ত, সৌর, এবং গাণপত্য।
তার কথায়, হিন্দু ধর্ম হচ্ছে দর্শনের সমন্বয়ে একটা পরম্পরা। একেকটি সম্প্রদায়ের একেকটি দর্শন রয়েছে। এই যে শাক্ত সম্প্রদায়ের একেবারে বিপরীতে রয়েছে বৈষ্ণব সম্প্রদায়। আবার সবাই যে বেদের পক্ষে তা নয়। এই দর্শনে চার্বাকের মতো স্বীকৃত দর্শন আছে, যেখানে নাস্তিকতার কথা বলা হয়েছে।
‘‘মূল হচ্ছে ব্রহ্মের ভাবনা। কেউ সাকার, কেউ নিরাকারভাবে ব্রহ্মের ভাবনায় যুক্ত থাকেন। ইসকন যে ভাবাদর্শ মেনে চলে, সেটা বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের দর্শন, তার সঙ্গে সময়ের সঙ্গে কিছু নতুন ভাবনা যুক্ত হয়েছে। তাই ইসকনের ভাবধারা নিশ্চিতভাবেই হিন্দু ধর্মেরই অঙ্গ। তাদের সেই স্বীকৃতি দেওয়া হয়ে থাকে সবসময়ে। যারা হিন্দু ধর্ম বিরোধী, তারাই এসব প্রশ্ন তুলে থাকে,’’ বলেন হিন্দু ধর্মের পণ্ডিত নবকুমার ভট্টাচার্য।
• ইসকনকে নিয়ে যেসব বিতর্ক
পশ্চিমা দেশসহ বিশ্বের নানাদেশে ইসকনের লাখো ভক্ত ছড়িয়ে আছে। তাদের মূল নাম ছাড়াও ইসকনের ভক্ত হিসাবে পৃথক একটি নাম দেওয়া হয়ে থাকে। ইসকনের বিখ্যাত ভক্তদের মধ্যে অনেকেই বিলাসবহুল জীবন ত্যাগ করে ব্রহ্মচারীর জীবন বেছে নিয়েছেন। ইসকনের বিখ্যাত ও ‘কোটিপতি’ সদস্যদের মধ্যে আছেন ফোর্ড মোটর্সের মালিক হেনরি ফোর্ডের প্রপৌত্র অ্যালফ্রেড ফোর্ড, দ্য বিটলসের অন্যতম মুখ জর্জ হ্যারিসন, কবি অ্যালেন গিনসবার্গ এবং অ্যাপলের সাবেক সিইও স্টিভ জবস।
বিখ্যাত মানুষদের সমাবেশ যেমন হয়েছে ইসকনে, তেমনই নানা সময়ে বিতর্কেও জড়িয়েছে ইসকন। যেমন সংঘ-প্রতিষ্ঠার গোড়ার দিক থেকেই সিঙ্গাপুরে ইসকন নিষিদ্ধ থেকেছে দীর্ঘকাল। সংঘটির রেজিস্ট্রেশন আটকিয়ে রাখা হয়েছিল। তবে পরে অন্য নাম নিয়ে সেদেশে শুরু হয় ইসকনের কর্মকাণ্ড, এখন সেখানে একটি মন্দির আছে এবং ইসকনের ভক্তরা খোলাখুলিই কাজ করেন।
এছাড়াও মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশে এখনও ইসকন তার কাজকর্ম পরিচালনা করতে পারে না। চীনেও তাদের গোপনে কাজ করতে হয় বলে ইসকনের ওয়েবসাইটে একটি পুরোনো নিবন্ধে লেখা হয়েছে। তবে পাকিস্তানে ইসকনের অন্তত ১২টি মন্দির রয়েছে বলে সংঘটি দাবি করে। রাশিয়াসহ অনেক দেশে ইসকনের ধর্মীয় প্রচারণার পদ্ধতি নিয়ে মামলা হয়েছে নানা সময়ে।
• বাংলাদেশে ইসকন কী কাজ করে?
সাম্প্রতিককালে ইসকনের বেশ কিছু কর্মকাণ্ড নিয়ে বাংলাদেশে নানা আলোচনা তৈরি হয়। সেদিন রাতে এক বিবৃতিতে ইসকন বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সনাতনী সংগঠন হিসেবে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের, যেমন- হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ও অন্যান্যদের ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং অধিকার রক্ষায় কাজ করেন তারা।
ইসকন বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য বিমলা প্রসাদ দাস বলেন, ‘‘আমরা সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও সেবামূলক কাজ করি।’’
গত মাসের শেষের দিকে আট দফা দাবিতে চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে একটি সমাবেশ করেছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের সদস্যরা। সেখানে তারা সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা ও নিপীড়নের বিচার, জড়িতদের শাস্তি, ক্ষতিপূরণ দেওয়া, সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন করার মতো দাবি জানান।
ইসকন বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক চারু চন্দ্র দাস ব্রহ্মচারী মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন, ‘‘ইসকন একটি আন্তর্জাতিক সংগঠন, যা গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মীয় আদর্শ ও সনাতনী মূল্যবোধকে ধারণ করে শান্তিপূর্ণভাবে ধর্মীয় চর্চা এবং মানবকল্যাণমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে। আমরা সর্বদা শান্তি, সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যের পক্ষে কাজ করেছি। ভবিষ্যতেও একই আদর্শে কাজ করতে অঙ্গীকারবদ্ধ।’’
বিবিসি বাংলা।