বাংলাদেশের ‘গার্মেন্টস শিল্পের গর্বে’ লালবাতি জ্বলা শুরু? অপরদিকে প্রমাদ গুনছে চিনও

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন শুল্কনীতিতে বিশ্ববাণিজ্যে বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে, যার সবচেয়ে বড় ধাক্কা খেয়েছে বাংলাদেশ ও চীনের অর্থনীতি। আমেরিকার বাজারে পণ্য রপ্তানিতে ১০ শতাংশ শুল্ক চাপানোর পর থেকেই বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি খাত বস্ত্রশিল্পে ধস নেমেছে। মাত্র এক মাসেই বাংলাদেশের রপ্তানিতে ২১ কোটি ডলারের পতন ঘটেছে, যা দেশের অর্থনীতিকে গভীর সংকটে ফেলেছে। বিপরীতে, ভারত ও ভিয়েতনাম তাদের কৌশলগত দূরদর্শিতার কারণে এই প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম ‘প্রথম আলো’ এবং আমেরিকার ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড কমিশনের (USITC) ও ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব কমার্সের আওতাধীন অফিস অব টেক্সটাইল অ্যান্ড অ্যাপারেলের (OTEXA) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, আমেরিকার এই সিদ্ধান্তে ভারতের মতো দেশগুলি সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন।
মূলত, বাংলাদেশের সমস্যা শুধু বাইরের শুল্কে নয়, অভ্যন্তরীণ কূটনৈতিক অদূরদর্শিতা, শুল্কনীতি সম্পর্কে দুর্বলতা, এবং আন্তর্জাতিক বাজারের গতিবিধি বোঝার ব্যর্থতা এর মূল কারণ। বাজার কোথায় যাচ্ছে, ক্রেতারা কী চাইছে, আমেরিকার রাজনীতি কোন পথে—এই সব বিষয়ে যে প্রস্তুতি থাকা দরকার, বাংলাদেশ তাতে বরাবরই পিছিয়ে।
গত ২ এপ্রিল ডোনাল্ড ট্রাম্প ৫৭টি দেশের পণ্যে পাল্টা শুল্ক চাপানোর সিদ্ধান্ত নেন। এর ফলে বাংলাদেশি পোশাকের ওপর শুল্ক ৩৭ শতাংশ থেকে বেড়ে ৫০ শতাংশ হতে চলেছে। এর সরাসরি প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের তথাকথিত ‘সফল’ বস্ত্রশিল্পে। এপ্রিল পর্যন্ত আমেরিকা বাংলাদেশে গড়ে ৭০-৮০ কোটি ডলারের মতো পোশাক রপ্তানি করত। কিন্তু মে মাসে সেটা কমে দাঁড়িয়েছে ৫৫ কোটি ডলারে। অর্থাৎ, এক মাসেই ২১ কোটি ডলারের বিশাল পতন! অথচ, এই সময়ে ঢাকা কেবল ‘প্রতিনিধি দল’ পাঠিয়ে আলোচনার নামে সময় নষ্ট করেছে, কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারেনি।
যে চীন একসময় গোটা দুনিয়ার কারখানা হিসেবে পরিচিত ছিল, তাদের অবস্থাও এখন বেহাল। মে মাসে তারা মাত্র ৫৬ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করেছে, যেখানে গত বছর একই মাসে রপ্তানি করেছিল ১১৬ কোটি ডলারের। এক বছরে তাদের রপ্তানিতে ৫২ শতাংশ পতন ঘটেছে! এই পতনকে অনেকেই চীনের নিজস্ব ভুলে বাজার হারানোর ফল হিসেবে দেখছেন। তবে চীনের চেয়ে বাংলাদেশের পরিস্থিতি আরও দুর্বল। কারণ, চীন এই পতন সত্ত্বেও প্রযুক্তিতে এগিয়ে এবং বিকল্প বাজারে তাদের শক্তিশালী অবস্থান রয়েছে। বাংলাদেশ সেখানে শুধু আমেরিকার বাজারের দিকে তাকিয়ে থাকে, তাদের কোনো বিকল্প প্রস্তুতি বা অভ্যন্তরীণ সংস্কার নেই।
এই পুরো টালমাটাল পরিস্থিতিতে যারা কৃতিত্বের দাবিদার, তারা হলো ভারত ও ভিয়েতনাম। শুধুমাত্র প্রতিক্রিয়াশীল না হয়ে, আগে থেকেই এগিয়ে থাকা সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা এবং কৌশলগত পদক্ষেপই আজ তাদের সফল করছে।
ভিয়েতনাম মে মাসেই ১২৩ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করেছে আমেরিকায়। একটানা পাঁচ মাস ধরে তারা ১ বিলিয়ন ডলারের বেশি রপ্তানি করে চিনকে সরিয়ে আমেরিকার শীর্ষ রপ্তানিকারক দেশে পরিণত হয়েছে। অন্যদিকে, ভারতের রপ্তানি খুব বেশি ওঠানামা করেনি। এপ্রিলের ৪৯ কোটি ডলার থেকে মে মাসে তা ৪৬ কোটি ডলারে নেমেছে, যা বাজারে তাদের স্থিতিশীল, কৌশলী এবং বিশ্বাসযোগ্য অবস্থান প্রমাণ করে।
এই পরিস্থিতি বাংলাদেশের জন্য একটি বড় শিক্ষা। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য এবং ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নিজেদের অবস্থান সুরক্ষিত রাখতে হলে শুধু আশায় বেঁচে থাকলে চলবে না, প্রয়োজন সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা এবং দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ।