
জম্মু ও কাশ্মীরে বিগত ২৫ বছরে বহু প্রাণঘাতী সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটেছে, যার ফলে অসংখ্য নিরীহ মানুষের জীবন কেড়ে নেওয়া হয়েছে। এই হামলাগুলি উপত্যকার নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে বারবার চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে এবং সেখানকার মানুষের জীবনে ভয়াবহ প্রভাব ফেলেছে। সাম্প্রতিক পাহেলগাম হামলায় বিপুল সংখ্যক পর্যটকের মৃত্যু ও আহতের ঘটনার প্রেক্ষিতে কাশ্মীরের এই রক্তাক্ত ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকানো জরুরি হয়ে উঠেছে।
এখানে বিগত আড়াই দশকে কাশ্মীরের কয়েকটি সবচেয়ে ভয়াবহ হামলার ঘটনা উল্লেখ করা হলো:
১. চিত্তি সিংপোরা গণহত্যা (২০ মার্চ, ২০০০):
তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের ভারত সফরের ঠিক আগে, ২০০০ সালের ২০ মার্চ অনন্তনাগ জেলার চিত্তি সিংপোরা গ্রামের শিখ সম্প্রদায়ের ৩৬ জন নিরীহ গ্রামবাসীকে জঙ্গিরা নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করে। এই হামলা কেবল প্রাণহানির জন্য নয়, বরং আন্তর্জাতিক কূটনীতির প্রেক্ষাপটেও ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়।
২. অমরনাথ যাত্রায় হামলা (আগস্ট, ২০০০):
হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের জন্য একটি পবিত্র তীর্থযাত্রা অমরনাথ যাত্রা জঙ্গিদের একটি বড় হামলার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। ২০০০ সালের আগস্ট মাসে এই হামলায় কমপক্ষে ৩২ জন তীর্থযাত্রী নিহত হন। এর পরবর্তী বছরগুলোতেও (২০০১, ২০০২, ২০১৭) অমরনাথ যাত্রায় বিচ্ছিন্ন হামলার ঘটনা ঘটেছে।
৩. শ্রীনগরের বিধানসভা ভবনে আত্মঘাতী হামলা (১ অক্টোবর, ২০০১):
কাশ্মীরের রাজধানী শ্রীনগরে বিধানসভা ভবনের ওপর ২০০১ সালের ১ অক্টোবর এক আত্মঘাতী হামলা চালানো হয়। বিস্ফোরক ভর্তি গাড়ি ব্যবহার করে চালানো এই হামলায় অন্তত ৩৬ জন নিহত হন। এটি কাশ্মীরের নিরাপত্তা ব্যবস্থার জন্য একটি বড় ধাক্কা ছিল।
৪. কালুচক সেনা ঘাঁটিতে হামলা (১৪ মে, ২০০২):
২০০২ সালের ১৪ মে জম্মুর কাছে কালুচক সেনা ঘাঁটিতে ভয়াবহ হামলা চালানো হয়। তৎকালীন মার্কিন কূটনীতিক ক্রিস্টিনা রোকা ভারতে সফররত অবস্থায় তিন জন জঙ্গি একটি বাসে গ্রেনেড ছুড়ে সেনা ঘাঁটির ভেতরে ঢুকে পড়ে। তারা সেনাবাহিনীর আবাসিক এলাকাতেও নির্বিচারে গুলি চালায়। এই হামলায় ৩৬ জন প্রাণ হারান, যার মধ্যে সেনা সদস্যদের পরিবারও ছিল।
৫. নদিমার্গ হত্যাকাণ্ড (২৩ মার্চ, ২০০৩):
২০০৩ সালের ২৩ মার্চ কাশ্মীরের পুলওয়ামা জেলার নদিমার্গ গ্রামে এক নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটে। এই হামলায় অন্তত ২৪ জন নিরীহ কাশ্মীরি পণ্ডিত গ্রামবাসীকে হত্যা করেন জঙ্গিরা। এই হামলাটিও দেশের ভেতরে ও বাইরে গভীর শোক ও ক্ষোভের জন্ম দেয় এবং উপত্যকায় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তোলে।
৬. উরি সেনাঘাঁটিতে হামলা (১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৬):
২০১৬ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর উত্তর কাশ্মীরের উরি শহরের কাছে অবস্থিত ভারতীয় সেনা ঘাঁটিতে এক সশস্ত্র হামলা চালানো হয়। পাকিস্তানভিত্তিক জইশ-ই-মোহাম্মদ গোষ্ঠীর সদস্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে যে তারা এই হামলায় ১৯ জন ভারতীয় সেনাকে হত্যা করেন। এই হামলার জবাবে ভারত নিয়ন্ত্রণ রেখা পেরিয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ‘সার্জিকাল স্ট্রাইক’ পরিচালনা করে।
৭. পুলওয়ামা আত্মঘাতী হামলা (১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯):
২০১৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি কাশ্মীরের পুলওয়ামায় ভারতীয় আধাসামরিক বাহিনী সিআরপিএফ-এর একটি কনভয়ে ভয়াবহ আত্মঘাতী হামলা চালানো হয়। জইশ-ই-মোহাম্মদের এক আত্মঘাতী বোমারু বিস্ফোরক ভর্তি গাড়ি নিয়ে কনভয়ের একটি বাসকে আঘাত করেন। এতে অন্তত ৪০ জন জওয়ান শহিদ হন। এই হামলার জেরে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ব্যাপক উত্তেজনা সৃষ্টি হয় ও সীমান্তে যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি হয়।
৮. জম্মুতে তীর্থযাত্রীবাহী বাসে হামলা (৯ জুন, ২০২৪):
সবচেয়ে সাম্প্রতিক হামলাগুলির মধ্যে অন্যতম এটি। ২০২৪ সালের ৯ জুন জম্মুর রিয়াসি জেলায় একটি ধর্মীয় তীর্থস্থানে যাওয়ার পথে হিন্দু তীর্থযাত্রীদের বহনকারী একটি বাসে গুলি চালান জঙ্গিরা। এতে অন্তত ৯ জন নিহত হন ও আরও অনেকে আহত হন। এই ঘটনায় ভারতের বিভিন্ন মহলে নিন্দার ঝড় ওঠে এবং নিরাপত্তা জোরদার করা হয়।
পহেলগাম হামলার প্রেক্ষাপটে বিগত ২৫ বছরে কাশ্মীরে ঘটে যাওয়া এই ভয়াবহ হামলাগুলির দিকে ফিরে তাকালে উপত্যকার নিরাপত্তা পরিস্থিতি এবং সন্ত্রাসবাদের ভয়াবহতা স্পষ্ট হয়। এই হামলাগুলিতে বহু নিরীহ মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে এবং উপত্যকার শান্তি ও স্বাভাবিক জনজীবন বারবার ব্যাহত হয়েছে। এই ইতিহাস উপত্যকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার চ্যালেঞ্জ এবং সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় অবিরাম প্রচেষ্টার প্রয়োজনীয়তাকে স্মরণ করিয়ে দেয়।