
টারবাইন ছাড়াই শুধুমাত্র নদীর স্রোতকে কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের অভিনব পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন খড়্গপুর আইআইটির একদল গবেষক। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার কেশিয়াড়ি ব্লকের সুবর্ণরেখা নদীতে স্থানীয় শ্রমিকদের সহায়তায় গত পাঁচ-ছয় মাস ধরে এই প্রকল্প চালিয়ে যাচ্ছেন তারা। ইতিমধ্যেই নদীর স্রোত থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ দিয়ে এলইডি বাল্ব জ্বালিয়ে প্রাথমিক সাফল্য পেয়েছেন গবেষকরা। আগামী ছয় মাসের মধ্যে এই বিদ্যুৎ ব্যবহার করে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্বপ্নের প্রকল্প ‘জঙ্গলকন্যা সেতু’কে আলোকিত করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
এই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য হলো পরিবেশবান্ধব পদ্ধতিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং স্থানীয় পর্যটন ও অর্থনীতির উন্নয়ন। গবেষক দলের দুই সদস্য ওঙ্কার ভেঙ্কটইয়াল্লা এবং সৈকত নন্দী জানান, এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে নদীর স্রোত থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ দিয়ে স্পিড বোট চালানোর পরিকল্পনাও রয়েছে।
কী এই প্রযুক্তি?
জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রচলিত পদ্ধতিতে টারবাইন ব্যবহার করা হয়, যার জন্য জলের গভীরতা এবং শক্তিশালী স্রোত প্রয়োজন। এছাড়াও বাঁধ নির্মাণের জন্য বিপুল ব্যয় হয়। কিন্তু আইআইটি খড়্গপুরের গবেষকরা বিকল্প পদ্ধতিতে ‘এনার্জি হারভেস্টিং মেশিন’ তৈরি করেছেন, যা নদীর অল্প স্রোত থেকেই বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে সক্ষম। এই প্রযুক্তিকে ‘ভোর্টেক্স ইনডিউসড ভাইব্রেশন’ বলা হয়, যেখানে জলের স্রোতের কম্পনকে কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়।
গবেষক সৈকত নন্দী বলেন, “এই প্রযুক্তির জন্য জলের গভীরতা মাত্র ৬-১০ ফুট এবং স্রোতের গতি ঘণ্টায় ১.৮-২ কিলোমিটার হলেই যথেষ্ট। এটি একটি মোবাইল টেকনোলজি, যাকে সহজেই এক স্থান থেকে অন্য স্থানে স্থানান্তর করা যায়।”
গবেষণার পথযাত্রা
২০১৮-১৯ সাল থেকে আইআইটি খড়্গপুরের ওশান ইঞ্জিনিয়ারিং এবং নেভাল আর্কিটেকচার বিভাগের গবেষকরা এই প্রযুক্তি নিয়ে কাজ শুরু করেন। ওঙ্কার ভেঙ্কটইয়াল্লার নেতৃত্বে হানিলুপ টেকনোলজি প্রাইভেট লিমিটেড নামে একটি স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়। ব্রিটেনের রয়্যাল অ্যাকাডেমি অফ ইঞ্জিনিয়ারিং-এর সহযোগিতায় ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সুবর্ণরেখা নদীতে প্রথম পরীক্ষামূলকভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সাফল্য অর্জন করেন তারা।
স্থানীয় উন্নয়নে ভূমিকা
এই প্রকল্পের মাধ্যমে স্থানীয় পর্যটন ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। ওঙ্কার ভেঙ্কটইয়াল্লা বলেন, “প্রাথমিকভাবে পর্যটনের বিকাশ ঘটিয়ে আমরা স্থানীয় কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে চাই। নদীর স্রোত থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ দিয়ে নৌকা বা স্পিড বোট চালানোর পরিকল্পনা রয়েছে।”
তিনি আরও জানান, এই পদ্ধতিতে ১ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে খরচ পড়বে প্রায় দেড় লক্ষ টাকা। স্থানীয় শ্রমিকদের সহায়তায় এবং প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
গবেষকদের লক্ষ্য হলো আগামী ছয় মাসের মধ্যে কেশিয়াড়ির ভসরাঘাট এলাকায় অবস্থিত ‘জঙ্গলকন্যা সেতু’কে এই বিদ্যুৎ দিয়ে আলোকিত করা। এছাড়াও এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে নদীবক্ষে পরিবেশবান্ধব যানবাহন চালানোর পরিকল্পনা রয়েছে।
এই উদ্ভাবনী প্রযুক্তি শুধুমাত্র পশ্চিমবঙ্গ নয়, সারা দেশের জন্য একটি মাইলফলক হতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। নদীর স্রোতকে কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের এই পদ্ধতি ভবিষ্যতে গ্রামীণ এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহের একটি বড় সমাধান হতে পারে।