
কালীগঞ্জ উপনির্বাচনে তৃণমূলের বিপুল জয়ের পর বিজয় মিছিল ঘিরে বোমাবাজিতে এক চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রীর মৃত্যু রাজ্যে ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি করেছে। নিহত বালিকার মায়ের অভিযোগ, সিপিএম-কে ভোট দেওয়ার কারণেই তার মেয়েকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে খুন করা হয়েছে। এই মর্মান্তিক ঘটনায় গভীর দুঃখপ্রকাশ করেছেন সদ্য জয়ী তৃণমূল প্রার্থী আলিফা আহমেদ, যিনি যেকোনো মূল্যে দোষীদের কঠোরতম শাস্তি দাবি করেছেন।
অভিযোগ উঠেছে, তৃণমূলের বিজয় মিছিল থেকেই বোমা ছোড়া হয়, যার ফলে একটি ৯ বছরের বালিকার প্রাণহানি হয়। নিহত বালিকার মোলান্ডির বাড়িতে শোকের আবহ বিরাজ করছে। স্থানীয়দের দাবি, এই ঘটনায় গ্রেফতার হওয়া চারজনই তৃণমূল কর্মী। নিহত বালিকার মায়ের অভিযোগ, তাদের পরিবার সিপিএম সমর্থক হওয়ার কারণেই তাদের উপর পরিকল্পিতভাবে হামলা চালানো হয়েছে।
জয়ী তৃণমূল প্রার্থী আলিফা আহমেদ, যিনি নিজে একজন মা, এই ঘটনায় গভীরভাবে মর্মাহত। তিনি বলেন, “আমি নিজে একজন মা। আমার ছোট বাচ্চা রয়েছে। একটা মায়ের কোল থেকে বাচ্চা কেড়ে নেওয়া কী জিনিস, আমি বুঝি। খুব দুঃখ লাগছে যে, আমি মেয়েটাকে ফিরিয়ে আনতে পারব না।” তিনি আরও বলেন, “আপনাদের কাছ থেকে প্রথম শুনতে পেরেছি এবং বাইরে বেরিয়ে যখন বিশদভাবে শুনলাম, আমি সাংঘাতিকভাবে মর্মাহত হয়েছি এবং সেই মুহূর্তে আমার জয়ের কোনও আনন্দ আর বাকি ছিল না।”
আলিফা আহমেদ স্পষ্ট জানিয়েছেন যে, এই ঘটনার পর কালীগঞ্জে কোনো বিজয় উল্লাস হবে না। তিনি বলেন, “আমরা কালীগঞ্জের একটা মেয়েকে হারিয়েছি, একটা বাচ্চাকে হারিয়েছি, একটা মায়ের কোল খালি হয়েছে, সেই জায়গা থেকে আমি অন্তত কোনও সেলিব্রেশনে অংশগ্রহণ করতে পারব না।” তিনি জোর দিয়ে বলেছেন, “যারা এর পিছনে দায়ী, তাদের দল-মত-বর্ণ কিছু যেন না দেখা হয়, তাদের যেন কঠোরতম শাস্তি হয়।”
উল্লেখ্য, ভোট গণনার আগেই আলিফা আহমেদ সমাজ মাধ্যমে তার কর্মীদের সংযত থাকার বার্তা দিয়েছিলেন। রবিবার ফেসুবক পোস্টে তিনি লিখেছিলেন, “আমার প্রিয় কালীগঞ্জবাসী, আগামীকাল (সোমবার) কালীগঞ্জ উপনির্বাচনের ভোট গণনা হবে। এই লড়াইয়ে কেউ জয়ী হবেন, কেউ পরাজিত হবেন। কিন্তু এই লড়াইয়ে কখনও ব্যক্তিগত শত্রুতা নয়। আমি সকলের কাছে অনুরোধ করব, যে আগামীকাল (সোমবার) কেউ উত্তেজনার বশে, উৎসাহের বশে অন্য কোনও মানুষের আত্মসম্মানকে আঘাত করবেন না।”
কালীগঞ্জের এই মর্মান্তিক ঘটনা রাজনৈতিক হিংসার এক নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। জয়ী প্রার্থীর দুঃখপ্রকাশ এবং দোষীদের শাস্তির দাবি, এই ঘটনার নৈতিক ও মানবিক দিককে তুলে ধরেছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এখন এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত এবং দোষীদের দ্রুত শাস্তির মুখোমুখি করার চ্যালেঞ্জের মুখে।
বিশ্লেষণমূলক সংবাদ প্রতিবেদন
কালীগঞ্জের বিজয় উল্লাস বনাম মানবিক বিপর্যয়: এক ন’বছরের শিশুর মৃত্যু, আস্থার সংকট ও রাজনৈতিক দায়বদ্ধতার প্রশ্ন
কালীগঞ্জ উপনির্বাচনে তৃণমূলের বিপুল জয়ের আনন্দ বদলে গেছে এক মর্মান্তিক বিষাদে। বিজয় মিছিল থেকে বোমাবাজির ঘটনায় এক ন’বছরের শিশুর মৃত্যুর অভিযোগ রাজ্যের রাজনৈতিক হিংসার এক ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরেছে। যে শিশুর জীবন কেবল শুরু হয়েছিল, তাকে রাজনীতির বলির পাঁঠা হতে হলো। এই ঘটনা কেবল একটি দুর্ঘটনা নয়, এটি রাজনৈতিক দায়বদ্ধতা, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি এবং গণতন্ত্রের নামে সহিংসতার এক কদর্য প্রতিচ্ছবি।
আলিফা আহমেদের বিজয়ী হওয়ার আনন্দ মুহূর্তেই ম্লান হয়ে গেছে এক শিশুর মৃত্যুতে। একজন সদ্য নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হিসেবে তাঁর ‘আমি নিজে একজন মা… এই মুহূর্তে আমার জয়ের কোনও আনন্দ আর বাকি ছিল না’ – এই উক্তি তাঁর মানবিক সংবেদনশীলতা প্রকাশ করে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, তাঁর এই অনুভূতি কি কেবল ব্যক্তিগত দুঃখেই সীমাবদ্ধ, নাকি এটি দলীয় কর্মী-সমর্থকদের উগ্র আচরণের প্রতি এক বৃহত্তর রাজনৈতিক দায়বদ্ধতার ইঙ্গিত? মিছিলে সংযত থাকার জন্য তাঁর পূর্বের সামাজিক মাধ্যমের বার্তা কি কেবল আনুষ্ঠানিকতা ছিল, নাকি তার কঠোর প্রয়োগের অভাব ছিল? যদি দলীয় কর্মীরাই এই ঘটনায় জড়িত থাকে, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে কী ধরনের কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়, তার ওপরই নির্ভর করবে জনগণের আস্থার ভবিষ্যৎ।
নিহত বালিকার মায়ের অভিযোগ, সিপিএম-কে ভোট দেওয়ার কারণেই তাঁর মেয়েকে ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে খুন’ করা হয়েছে, এটি এক অত্যন্ত গুরুতর অভিযোগ। এটি রাজ্যের রাজনৈতিক হিংসার সেই পুরোনো ক্ষতকেই আবারও উন্মোচন করেছে, যেখানে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা প্রায়শই রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে রূপান্তরিত হয়। এই ধরনের ঘটনা শুধু আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিকেই ভঙ্গুর করে না, বরং সাধারণ মানুষের মনে পুলিশের প্রতি আস্থাহীনতা এবং বিচার ব্যবস্থার প্রতি হতাশার জন্ম দেয়। যদি ‘দায়ী যেই হোক কঠোরতম শাস্তি হয়’ – এই দাবি কার্যকর না হয়, তবে তা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের প্রতি সহিংসতাকে আরও ইন্ধন যোগাবে।
একটি উপনির্বাচনের ফল প্রকাশের দিনে বিজয় উল্লাস এমন চরম হিংসার জন্ম দেবে, তা কোনো গণতান্ত্রিক সমাজের জন্য কাম্য নয়। গণতন্ত্রের অর্থ হল শান্তিপূর্ণভাবে মত প্রকাশের স্বাধীনতা, প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুস্থ পরিবেশ এবং জনগণের রায়কে সম্মান জানানো। কিন্তু বোমাবাজির মতো ঘটনা, বিশেষ করে যখন এর শিকার হয় একজন নিরীহ শিশু, তখন তা গণতন্ত্রের মূল ভিত্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। এটি কেবল আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখার ব্যর্থতা নয়, বরং রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মীদের মধ্যে নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়কেও নির্দেশ করে।
কালীগঞ্জের এই মর্মান্তিক ঘটনাটি বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসের এক কালো অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হবে। এক ন’বছরের শিশুর মৃত্যু কেবল একটি সংখ্যামাত্র নয়, এটি রাজনৈতিক হিংসার বিরুদ্ধে একটি স্পষ্ট হুঙ্কার। জয়ী প্রার্থীর মানবিক প্রতিক্রিয়া এবং কঠোর শাস্তির দাবি অবশ্যই ইতিবাচক, কিন্তু এই দাবির বাস্তবায়নই প্রমাণ করবে যে, রাজনৈতিক দলগুলি সত্যিই সহিংসতামুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করতে চায়, নাকি কেবল জনরোষ প্রশমিত করার চেষ্টা করছে। এই ঘটনা রাজ্যের রাজনৈতিক সংস্কৃতি এবং আইন-শৃঙ্খলা ব্যবস্থার জন্য এক বড় পরীক্ষা।