
গত বছরের ৫ অগাস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বাংলাদেশে রাজনৈতিক সমীকরণ দ্রুত বদলাচ্ছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আগামী বছরের জুনের মধ্যে জাতীয় নির্বাচনের কথা বললেও, বিএনপি সহ কয়েকটি বিরোধী দল চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন দাবি করছে। তবে সম্প্রতি লন্ডন বৈঠকের পর নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে একটি সমঝোতার ইঙ্গিত মিলেছে। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন মূল আলোচনা আসন্ন জাতীয় নির্বাচন এবং এর প্রধান আকর্ষণ – বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার সম্ভাব্য প্রত্যাবর্তন।
প্রায় দুই দশক ধরে বাংলাদেশের সরাসরি নির্বাচনী মাঠে অনুপস্থিত বেগম খালেদা জিয়া। বিএনপি সূত্রে খবর, আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি অংশ নিতে পারেন। দলের একাধিক সূত্রের নাম প্রকাশ না করার শর্তে নিশ্চিত করেছে যে, খালেদা জিয়াকে এবার বগুড়া, ফেনী এবং দিনাজপুর – এই তিনটি গুরুত্বপূর্ণ আসনে প্রার্থী করার সম্ভাবনা রয়েছে। এর মধ্যে বগুড়া-৬ অথবা ৭ আসন থেকে তার নির্বাচন অনেকটাই নিশ্চিত বলে মনে করা হচ্ছে। উল্লেখ্য, বগুড়া-৭ আসনটি (গাবতলী-শাহজাহানপুর) প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ও খালেদা জিয়ার স্বামী জিয়াউর রহমানের জন্মভূমি হওয়ায় এটি বিএনপির কাছে বরাবরই বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।
বগুড়া দীর্ঘদিন ধরে বিএনপির এক শক্তিশালী ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। ১৯৯১ থেকে ২০০৮ সালের মধ্যে একাধিকবার এখান থেকে নির্বাচন করে খালেদা জিয়া প্রতিবারই বিপুল ব্যবধানে জয়ী হয়েছেন। বিএনপির একজন শীর্ষ নেতা বলেছেন, “বগুড়া আমাদের জন্য শুধু একটি আসন নয়, এটি আমাদের রাজনীতির প্রতীক।” দলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, খালেদা জিয়া ফেনী-১, বগুড়া-৬ অথবা ৭ এবং দিনাজপুর জেলার একটি আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন। বেগম জিয়ার শক্তিশালী অতীত প্রভাব বগুড়ার রাজনীতিতে অনস্বীকার্য। তার প্রত্যাবর্তন এসব এলাকায় নির্বাচনী সমীকরণে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে পারে।
খালেদা জিয়া ছাড়াও, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এবং মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও একাধিক আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন বলে শোনা যাচ্ছে। তবে, কেউ একাধিক আসনে ‘ধানের শীষ’ প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে নামতে পারবেন না বলে জানা গেছে। তারেক রহমানের নির্দেশেই ইতোমধ্যে সম্ভাব্য প্রার্থীদের একটি তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে। এই তালিকায় প্রায় ২০টি জেলায় জোটের শরিক দলগুলোর জন্য আসন বরাদ্দ রাখা হয়েছে বলে খবর।
খালেদা জিয়ার অতীত নির্বাচনী রেকর্ড পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, তিনি বগুড়া, ফেনী, লক্ষ্মীপুর এবং চট্টগ্রামের আসন থেকে বেশি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। এছাড়াও ১৯৯১ সালে ঢাকার একটি আসন থেকে এবং ২০০১ সালে খুলনার একটি আসন থেকেও তিনি ভোটে লড়েছেন। নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তিনি শুধু জয়লাভই করেননি, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের সঙ্গে তাঁর ভোটের ব্যবধানও ছিল অনেক বেশি।
১৯৯১ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত চারটি সংসদ নির্বাচনে খালেদা জিয়া প্রতিবারই পাঁচটি আসনে প্রার্থী হয়ে সবকটিতেই জয়লাভ করেন। এমনকি ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি নির্বাচনেও তিনি প্রার্থী ছিলেন। ২০০৮ সালে তিনটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে তিনি সবকটিতেই জয়ী হন। যদিও ২০১৪ এবং ২০২৪ সালের নির্বাচন বিএনপি বর্জন করেছিল, তবে ২০১৮ সালে তিনটি আসনে প্রার্থী হয়েও দুর্নীতির মামলায় দণ্ডিত হওয়ায় খালেদা জিয়া নির্বাচন থেকে বাদ পড়েছিলেন।
তবে, ২০২৪ সালে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আদালতের রায়ে তাঁর বিরুদ্ধে থাকা সব মামলা খারিজ হয়ে যায়। সুপ্রিম কোর্টের রায় অনুযায়ী, বর্তমানে তাঁর নির্বাচনে দাঁড়ানো নিয়ে আর কোনো আইনি বাধা নেই। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানিয়েছেন, শারীরিকভাবে সুস্থ থাকলে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেবেন। তাঁর এই প্রত্যাবর্তন বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক নতুন মাত্রা যোগ করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।