
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) প্রযুক্তির অন্যতম পথিকৃৎ জিওফ্রি হিন্টনের ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী, আগামী এক দশকের মধ্যেই এআই-ভিত্তিক চ্যাটবট শিক্ষাক্ষেত্রে মানুষের চেয়ে দ্বিগুণ কার্যকর হয়ে উঠবে। তবে এই দ্রুত বিকাশ শিক্ষাব্যবস্থায় নতুন সম্ভাবনা তৈরির পাশাপাশি, শিক্ষকদের ভূমিকা, শিক্ষার মানবীয় দিক এবং ভবিষ্যতের সম্ভাব্য বিপদ নিয়ে গুরুতর বিতর্ক সৃষ্টি করেছে।
বার্লিনে আয়োজিত গিটেক্স ইউরোপ সম্মেলনে হিন্টন জোর দিয়ে বলেছেন, “এআই শিক্ষক এখনো পুরোপুরি প্রস্তুত নয়, তবে দ্রুতই বাস্তবে রূপ নেবে। এআই শিক্ষক ব্যবহার করে বিভিন্ন স্তরে শিক্ষার মান উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়বে।” তিনি মনে করেন, ব্যক্তিগত শিক্ষকের সহায়তায় শিক্ষার্থীরা দ্বিগুণ গতিতে শেখে কারণ এআই প্রতিটি শিক্ষার্থীর বোঝাপড়ার স্তর বুঝে সেই অনুযায়ী ব্যাখ্যা দিতে পারবে। লাখ লাখ শিক্ষার্থীর শেখার অভিজ্ঞতা বিশ্লেষণ করে এআই নিজেই নিজের দক্ষতা আরও উন্নত করবে।
শিক্ষকদের ভূমিকা কি বদলে যাবে?
যুক্তরাজ্যে ইতিমধ্যে পরীক্ষামূলকভাবে কিছু বিদ্যালয়ে এআইভিত্তিক শিক্ষক ব্যবহার শুরু হয়েছে। মেটার তৈরি চ্যাটবট ‘মান্ডা’ যুক্তরাজ্যের কয়েকটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে গণিত ও ইংরেজি শেখাতে ব্যবহার হচ্ছে। এটি ১১ থেকে ১৬ বছর বয়সী শিক্ষার্থীদের জন্য জাতীয় পাঠ্যক্রম অনুসরণ করে পাঠদান করে। ‘মান্ডা’র প্রশিক্ষণের জন্য ৩০০ শিক্ষকের ব্যাখ্যাসমৃদ্ধ ৫ লাখ ৫০ হাজার মিনিটের ভিডিও ও অডিও উপাত্ত ব্যবহার করা হয়েছে।
গত বছর লন্ডনের ডেভিড গেইম কলেজ ‘শিক্ষকবিহীন’ জিসিএসই শ্রেণিকক্ষে এআই ও ভার্চ্যুয়াল রিয়েলিটি (ভিআর) প্রযুক্তির মাধ্যমে পাঠদান শুরু করে। কলেজটির সহ-অধ্যক্ষ জন ডালটন স্বীকার করেছেন, “অনেক ভালো শিক্ষক রয়েছেন। তবে আমরা সবাই মানুষ, ভুল করতেই পারি। কিন্তু এআই যেভাবে প্রতিটি শিক্ষার্থীর শেখার গতি, দুর্বলতা ও অগ্রগতি বিশ্লেষণ করতে পারে, সেটি মানুষের পক্ষেই সম্ভব নয়।”
এখানেই প্রশ্ন উঠছে: যদি এআই প্রতিটি শিক্ষার্থীর দুর্বলতা নিখুঁতভাবে শনাক্ত করে ব্যক্তিগত পাঠ পরিকল্পনা তৈরি করতে পারে, তবে ঐতিহ্যবাহী শিক্ষকদের ভূমিকা কি কেবল পাঠ্যক্রমের সীমানায় সীমাবদ্ধ থাকবে? এআই শিক্ষক যদি মাসিক ১০ পাউন্ডের মতো সাশ্রয়ী হয়, তবে কি ভবিষ্যতে শিক্ষক নিয়োগের প্রবণতা কমে যাবে?
মানবীয় সংযোগ বনাম এআইয়ের দক্ষতা
শিক্ষকদের বাড়তি কাজের চাপ, সময়-সংকট ও শ্রেণিকক্ষের সীমাবদ্ধতার কারণে অনেকেই এখন পাঠ পরিকল্পনা তৈরি, হোমওয়ার্ক মূল্যায়ন ও প্রতিক্রিয়া দেওয়ার কাজে এআইয়ের সহায়তা নিচ্ছেন। এআই undoubtedly দক্ষতার দিক থেকে মানুষের চেয়ে এগিয়ে। কিন্তু শিক্ষা কেবল তথ্যের আদান-প্রদান নয়, এটি শিক্ষার্থীদের মানসিক বিকাশ, সামাজিক দক্ষতা এবং নৈতিক মূল্যবোধ তৈরিতেও সাহায্য করে। একজন শিক্ষকের মানবিক স্পর্শ, সহানুভূতি এবং ব্যক্তিগত নির্দেশনা কি কোনো এআই চ্যাটবট দিতে পারবে? শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকের সঙ্গে শিক্ষার্থীর যে ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে ওঠে, তা কি কেবল ডিজিটাল স্ক্রিনের মাধ্যমে সম্ভব?
‘সুপার ইন্টেলিজেন্স’-এর অজানা বিপদ
জিওফ্রি হিন্টন, যিনি এআই-এর উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখাচ্ছেন, তিনিই এই প্রযুক্তির দ্রুত বিকাশ নিয়ে গুরুতর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি সতর্ক করেছেন যে, “আগামী দুই দশকের মধ্যেই এআই ‘সুপার ইন্টেলিজেন্স’ বা মানুষের চেয়েও বেশি বুদ্ধিমত্তার অধিকারী হতে পারে। আমরা এমন কিছু তৈরি করছি, যা আমাদেরই অজানা সত্তা। এগুলোকে নিরাপদ রাখার উপায় আমরা এখনো জানি না।”
এই উদ্বেগ ইঙ্গিত দেয় যে, শিক্ষাক্ষেত্রে এআই-এর ব্যবহার যদি নিয়ন্ত্রিত না হয়, তবে এটি কেবল সুযোগই নয়, বরং মানব সভ্যতার জন্য এক অজানা বিপদও ডেকে আনতে পারে। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ, এআই-এর নৈতিক ব্যবহার এবং এর দীর্ঘমেয়াদী সামাজিক প্রভাব নিয়ে এখনই গভীর আলোচনা ও নীতি নির্ধারণ জরুরি। কারণ শিক্ষা কেবল আজকের প্রজন্মের ভবিষ্যৎ নয়, বরং আগামী দিনের সমাজের ভিত্তি।
(সূত্র: ডেইলি মেইল)