মানুষের সহায়তা ছাড়াই ‘সফল অস্ত্রোপচার’ রোবটের, ১৭ মিনিটে হয়েগেলো জটিল অপারেশন

চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাসে এক নতুন মাইলফলক স্থাপন করল রোবট। প্রথমবারের মতো মানুষের কোনো সহায়তা ছাড়াই সম্পূর্ণ বাস্তবসম্মত উপায়ে জটিল অস্ত্রোপচার সফলভাবে সম্পন্ন করেছে একটি রোবট। বুধবার জনস হপকিন্স ইউনিভার্সিটির গবেষকরা এই যুগান্তকারী সাফল্যের কথা ঘোষণা করেছেন।
গবেষকরা জানিয়েছেন, ‘সার্জিক্যাল রোবট ট্রান্সফরমার-হায়ারার্কি’ বা SRT-H নামের এই রোবটটি নিখুঁত ও ধৈর্যের সঙ্গে রোগীর পিত্তথলি অপসারণের মতো দীর্ঘ ও জটিল পরীক্ষামূলক ধাপ সম্পন্ন করেছে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, এটি গবেষকদের কণ্ঠের নির্দেশনা মেনে কাজ করেছে এবং বাস্তব চিকিৎসা পরিস্থিতির মতো হঠাৎ ঘটে যাওয়া জটিল অবস্থার মধ্যেও একজন দক্ষ সার্জনের মতোই সক্ষমতা দেখিয়েছে।
মেডিকেল রোবোটিস্ট বিশেষজ্ঞ অ্যাক্সেল ক্রিগার এক বিবৃতিতে বলেছেন, “এ অগ্রগতি আমাদেরকে নির্দিষ্ট অস্ত্রোপচারের কাজ করতে পারে এমন রোবট থেকে অস্ত্রোপচারের পুরো প্রক্রিয়াটি সত্যিকার অর্থে বুঝতেও পারে এমন রোবটের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন। এর ফলে আমাদের চিকিৎসাসেবায় জটিল ও অনিশ্চিত পরিস্থিতিতেও কার্যকরভাবে কাজ করার মতো স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রোপচার ব্যবস্থাকে আরও হাতের নাগালে নিয়ে এসেছে।”
কীভাবে প্রশিক্ষণ পেল রোবটটি?
SRT-H রোবটটি অস্ত্রোপচারের ভিডিও দেখে প্রশিক্ষণ নিয়েছে, যেখানে জনস হপকিন্সের সার্জনরা শুকরের মৃতদেহে সেইসব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছেন। এসব ভিডিওতে প্রতিটি ধাপের ব্যাখ্যাসহ ক্যাপশন রয়েছে, যা রোবটকে এই জটিল কাজগুলো বুঝতে ও শিখতে সাহায্য করেছে। জনস হপকিন্স ইউনিভার্সিটি জানিয়েছে, এসব ভিডিও দেখার পর রোবটটি অস্ত্রোপচার শতভাগ নিখুঁতভাবে সম্পন্ন করেছে। যদিও অস্ত্রোপচারের সময় কিছুটা বেশি লেগেছে, তবুও এর ফলাফল একজন দক্ষ সার্জনের কাজের মতোই।
ব্রিটিশ দৈনিক ইন্ডিপেনডেন্টের প্রতিবেদন অনুযায়ী, রোবটটি তৈরি হয়েছে একই মেশিন-লার্নিং আর্কিটেকচারের ওপর ভিত্তি করে, যেটি ওপেনএআই-এর জনপ্রিয় চ্যাটজিপিটিকে চালিত করে। গবেষকরা বলছেন, এই রোবটকে মোট ১৭ মিনিট ধরে বিভিন্ন জটিল কাজ সম্পন্ন করতে হয়েছে, যার মধ্যে ছিল শিরা ও ধমনি শনাক্ত করা এবং সেগুলোকে সঠিকভাবে ধরতে পারা, সঠিক জায়গায় ক্লিপ বসানো ও কাঁচি দিয়ে নির্দিষ্ট অংশ কেটে ফেলা।
পূর্ববর্তী সাফল্য ও বর্তমানের অগ্রগতি
এর আগে, ক্রিগারের তৈরি ‘স্মার্ট টিস্যু অটোনোমাস রোবট’ নামের একটি রোবট তিন বছর আগে প্রথমবারের মতো জীবন্ত একটি শুকরের ওপর স্বয়ংক্রিয় রোবটিক অস্ত্রোপচার বা ‘ল্যাপারোস্কোপিক সার্জারি’ সম্পন্ন করেছিল। তবে সেই রোবটটি তখন কেবল বিশেষভাবে চিহ্নিত টিস্যুতে কাজ করতে পারত। নির্মাতাদের দাবি, এখনকার SRT-H রোবটটি এর চেয়েও উন্নত।
গবেষকরা বলছেন, অসামঞ্জস্যপূর্ণ শারীরিক অবস্থার মধ্যেও নিখুঁতভাবে কাজ করেছে SRT-H রোবট। গবেষকরা রোবটের প্রাথমিক অবস্থান বদলে এবং রক্তের মতো তরল রং ব্যবহার করে পিত্তথলি ও আশপাশের টিস্যুর চেহারা বদলে দিলেও এটি কার্যসক্ষমতা ও নিখুঁততার সঙ্গে অস্ত্রোপচার সম্পন্ন করেছে।
গবেষণা দলটি জানিয়েছে, পরবর্তী ধাপে আরও বিভিন্ন ধরনের অস্ত্রোপচারের ওপর এই রোবট সিস্টেমকে প্রশিক্ষণ দিতে এবং এর কার্যক্ষমতা পরীক্ষা করতে চায়। পাশাপাশি তারা রোবটের সক্ষমতার পরিসরও বাড়াতে চায়, যাতে সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয়ভাবে রোবটটি অস্ত্রোপচার নিজে নিজেই সম্পন্ন করতে পারে। এই যুগান্তকারী গবেষণাটি বিজ্ঞানভিত্তিক জার্নাল ‘সায়েন্স রোবোটিক্স’-এ প্রকাশিত হয়েছে।
এই গবেষণার প্রধান লেখক ও জনস হপকিন্স ইউনিভার্সিটি গবেষক ড. জি উং ‘ব্রায়ান’ কিম বলেছেন, “আগের বিভিন্ন প্রচেষ্টার চেয়ে বড় অগ্রগতি আমাদের এই গবেষণা। কারণ, বাস্তব জীবনে স্বয়ংক্রিয় বা অটোনোমাস সার্জিক্যাল রোবট ব্যবহারের ক্ষেত্রে কিছু মৌলিক বাধা দূর করার চেষ্টা করছে এটি। আমাদের গবেষণায় উঠে এসেছে, বিভিন্ন এআই মডেলকে এতটাই নির্ভরযোগ্য করে তোলা সম্ভব যে, এগুলো দিয়ে সার্জারিতে স্বয়ংক্রিয়তা আনা যাবে, যা একসময় কল্পনাতীত মনে হলেও এখন তা বাস্তব হয়ে উঠেছে।”