Science: রহস্যময় ‘তারা’র স্পন্দনে হতবাক বিজ্ঞানীরা, জেনেনিন কি বলছে গবেষকরা?

মহাকাশের অসীম রহস্যের ভাঁজে আরও একটি নতুন ধাঁধা উন্মোচিত হলো, যা বিশ্বজুড়ে জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের হতবাক করে দিয়েছে। পৃথিবী থেকে প্রায় ১৫ হাজার আলোকবর্ষ দূরে, ‘স্কুটাম’ নামের নক্ষত্রমণ্ডলে একটি অজানা বস্তু থেকে অদ্ভুত ধরনের আলোর ঝলকানি এবং সংকেত আসছে। প্রতি ৪৪ মিনিটে একবার করে এক্স-রে ও রেডিও সংকেতের মতো টিপটিপ করছে বা জ্বলছে এই মহাজাগতিক বস্তু, যা জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা আগে কখনও দেখেননি বলে জানিয়েছে টাইম ম্যাগাজিন।

অস্ট্রেলিয়ার ‘কার্টিন ইউনিভার্সিটি’র জ্যোতির্বিদ এবং এই গবেষণাপত্রের প্রধান লেখক জিটেং ওয়াং বলেন, “জ্যোতির্বিদরা সব ধরনের টেলিস্কোপ দিয়ে অসংখ্য তারা খতিয়ে দেখেছেন, তবে এমন আচরণ কোনো তারার মধ্যে আগে কখনও দেখা যায়নি। তারার মধ্যে এমন নতুন আচরণ দেখার বিষয়টি সত্যিই রোমাঞ্চকর।” এই রহস্যময় বস্তুর ওপর করা তাঁর গবেষণাটি সম্প্রতি বিজ্ঞানভিত্তিক জার্নাল ‘নেচার’-এ প্রকাশিত হয়েছে।

‘এএসকেএপি জে১৮৩২’: এক অজানা শ্রেণিবিন্যাস

বিজ্ঞানীরা এই রহস্যময় বস্তুটির নাম দিয়েছেন ‘এএসকেএপি জে১৮৩২’ (ASKAP J1832)। তবে এটি আসলে কী, সে বিষয়ে তাঁরা এখনও নিশ্চিত নন। এর সম্ভাব্য ব্যাখ্যাগুলোর মধ্যে রয়েছে শ্বেত বামন (এক ধরনের মৃত তারা) বা ম্যাগনেটার (খুব শক্তিশালী চৌম্বক শক্তিওয়ালা নিউট্রন তারা)। তবে বিজ্ঞানীরা বলছেন, এটি এসবের কিছুই না হয়ে একেবারে নতুন ধরনের কোনো মহাজাগতিক বস্তুও হতে পারে, যা আমাদের মহাজাগতিক বস্তুর শ্রেণিবিন্যাসকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে।

‘এএসকেএপি জে১৮৩২’ যেভাবে আলোর ঝলক পাঠাচ্ছে তা মহাবিশ্বে একেবারে প্রথম নয়। এ ধরনের আচরণ পালসার নামের বিভিন্ন বস্তুর মধ্যেও দেখা যায়। পালসার হলো দ্রুত ঘূর্ণায়মান নিউট্রন তারা, যেগুলো খুব দ্রুত (মিলিসেকেন্ড থেকে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে) রেডিও তরঙ্গ পাঠায়। তবে ‘এএসকেএপি জে১৮৩২’ আলোর ঝলক পাঠাচ্ছে ৪৪ মিনিট পরপর, যা পালসারের চেয়ে অনেক ধীরলয়ের।

২০২২ সালে বিজ্ঞানীরা নতুন এক ধরনের বস্তু আবিষ্কার করেন, যা ‘লং-পিরিয়ড ট্রানজিয়েন্ট’ নামে পরিচিত। এসব বস্তুও প্রতি মিনিটে আলোর ঝলক পাঠায়, ঠিক যেমন ‘এএসকেএপি জে১৮৩২’ পাঠাচ্ছে। এখন পর্যন্ত এরকম কেবল ১০টি বস্তুর সন্ধান পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা।

অনন্য বৈশিষ্ট্য: রেডিও ও এক্স-রে যুগলবন্দী এবং রহস্যময় পরিবর্তন

‘এএসকেএপি জে১৮৩২’-এর আলাদা হওয়ার কারণ হলো, এটিই প্রথম লং-পিরিয়ড ট্রানজিয়েন্ট, যা কেবল রেডিও নয়, এক্স-রে আলোও পাঠিয়েছে। এর আগে দেখা যাওয়া লং-পিরিয়ড ট্রানজিয়েন্টগুলো থেকে এক্স-রে বের হওয়ার প্রমাণ মেলেনি।

আশ্চর্যজনক বিষয় হলো, ‘এএসকেএপি জে১৮৩২’ যেভাবে রেডিও ও এক্স-রে সংকেত পাঠায়, সেটিও সময়ের সঙ্গে বদলাচ্ছে। ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে মহাকাশে থাকা নাসার ‘চন্দ্র এক্স-রে অবজারভেটরি’ দিয়ে পর্যবেক্ষণের সময় দেখা গিয়েছিল, এ বস্তুটি অনেক জোরে ও স্পষ্টভাবে রেডিও এবং এক্স-রে সংকেত পাঠাচ্ছিল। তবে ঠিক ছয় মাস পর আবার পর্যবেক্ষণে দেখা গেল এর রেডিও তরঙ্গ ছিল আগের তুলনায় ১ হাজার ভাগের এক ভাগ এবং ওই সময় এর এক্স-রে সংকেত শনাক্ত করা যায়নি।

এই আকস্মিক পরিবর্তন বিজ্ঞানীদের জন্য এক গভীর রহস্য। কারণ, এমন আচরণ আগে কোনো পরিচিত তারা বা মহাজাগতিক বস্তুতে দেখা যায়নি।

ব্যাখ্যার খোঁজে বিজ্ঞানীরা: নতুন দিগন্তের হাতছানি

এ গবেষণার সহ-লেখক ও বার্সেলোনার ‘ইনস্টিটিউট অফ স্পেস সায়েন্সেস’-এর নান্দা রিয়া একটি বিবৃতিতে বলেছেন, “আমরা নিউট্রন তারা ও শ্বেত বামন তারা নিয়ে বিভিন্ন ধরনের সম্ভাবনা খুঁজে দেখেছি। যেমন– এরা একা থাকলে কী হয়, আবার কোনো সঙ্গী তারা থাকলে কী হয় তা-ও বিবেচনা করেছি। তবে এখনও পর্যন্ত কোনো ব্যাখ্যা পুরোপুরি মিলে যায়নি। তবে এক্ষেত্রে কিছু ধারণা অন্যগুলোর চেয়ে একটু ভালো কাজ করেছে।”

বিজ্ঞানীদের একটি সম্ভাব্য ব্যাখ্যা হলো, এটি একটি ম্যাগনেটার। কিন্তু ‘এএসকেএপি জে১৮৩২’ যেভাবে উজ্জ্বল ও পরিবর্তনশীল রেডিও সংকেত পাঠায়, তা সাধারণ ম্যাগনেটারের সঙ্গে একেবারেই মেলে না। অন্য আরেকটি সম্ভাবনা হলো, এটি একটি শ্বেত বামন তারা। কিন্তু ‘এএসকেএপি জে১৮৩২’ যতটা শক্তি তৈরি করছে, তা করতে গেলে এই শ্বেত বামন তারার অন্য কোনো তারার সঙ্গে জোড়া বেঁধে থাকতে হবে, যেটি ‘বাইনারি সিস্টেম’ নামে পরিচিত। এখনও পর্যন্ত এর সেই দ্বিতীয় তারার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি, তাই এই ব্যাখ্যাও অনিশ্চিত।

পৃথিবী থেকে টেলিস্কোপের মাধ্যমে এটিকে দেখলে মনে হয়, এটি সুপারনোভা রেমন্যান্ট বা কোনো বিস্ফোরিত গ্যাস ও শক্তি কণার ভরা মেঘের মধ্যে রয়েছে। তবে গবেষকরা বলছেন, এটি আসলে অনেক দূরে অবস্থিত, যা একটি দৃশ্যমান বিভ্রান্তি তৈরি করছে। বিষয়টি অনেকটা সূর্যের দিকে তাকালে সামনে ভাসমান মেঘের মতো মনে হয়, যা আসলে সূর্যের কাছাকাছি নয়, বরং পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে রয়েছে।

‘এএসকেএপি জে১৮৩২’ এখনও এক রহস্যময় ধাঁধা, যা মহাজাগতিক বস্তুর বিবর্তন এবং আমাদের মহাবিশ্বের গভীর বোঝাপড়ায় নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে। বিজ্ঞানীরা আরও গভীর পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে এই রহস্যের জট খুলতে চেষ্টা করছেন।