AI-যেভাবে বদলে দিচ্ছে হোটেল ব্যবস্থাপনার ধরন, জেনেনিন কী কী কাজ করছে এই প্রযুক্তি?

প্রযুক্তি যখন বিশ্বের নানা শিল্পক্ষেত্রকে নতুন করে ঢেলে সাজাচ্ছে, তখন হোটেল শিল্পেও এর গভীর প্রভাব ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে। সম্প্রতি প্রকাশিত এক গবেষণা বলছে, হোটেল ব্যবস্থাপনার অনেক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বই এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) বা অ্যালগরিদমিক ম্যানেজমেন্ট নিজের হাতে তুলে নিচ্ছে। এর ফলে হোটেল ম্যানেজারদের প্রচলিত ভূমিকা এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে।
অ্যালগরিদমিক ম্যানেজমেন্ট কী করছে?
‘ইউনিভার্সিটি অফ সারে’ এবং ‘অক্সফোর্ড ব্রুকস ইউনিভার্সিটি’র গবেষকদের এই গবেষণাটি অ্যালগরিদমিক ম্যানেজমেন্ট (AM)-এর ক্রমবর্ধমান ভূমিকার উপর আলোকপাত করেছে। এএম হলো এক ধরণের স্মার্ট সিস্টেম যা পূর্বে মানুষের দ্বারা সম্পাদিত অনেক কাজ স্বয়ংক্রিয়ভাবে সম্পন্ন করতে পারে। বিজ্ঞানভিত্তিক সাইট নোরিজের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বহু হোটেলে ইতিমধ্যেই ঘর পরিষ্কারের সময়সূচি তৈরি করা, কোন ঘরটি আগে পরিষ্কার করা হবে তা নির্ধারণ করা এবং এমনকি কোন কর্মীর কখন ডিউটি থাকবে – এই ধরনের পরিচালনামূলক কাজগুলিতে এএম ব্যবহার করা হচ্ছে।
রুম বুকিংয়ের তথ্য, উপলব্ধ কর্মীর সংখ্যা এবং অতিথিদের চাহিদার মতো বিষয়গুলো বিশ্লেষণ করে এই সিস্টেমগুলো এমনভাবে কাজের বন্টন করে যাতে সর্বোচ্চ দক্ষতা অর্জন করা যায় এবং পরিচালনার খরচও অনেক ক্ষেত্রে কমে আসে। গবেষণায় দেখা গেছে, এই স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থাপনার কারণে মানুষের হাতে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ অনেকটাই সীমিত হয়ে গেছে। গবেষণার প্রধান লেখক ব্রানা জিয়ানু বলেছেন, “এই অ্যালগরিদমগুলো এখন এমন সব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, যার জন্য আগে মানুষের বিচার-বিবেচনা এবং অভিজ্ঞতার প্রয়োজন ছিল।”
গবেষণাটি বিজ্ঞানভিত্তিক জার্নাল ‘ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অফ হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট’-এ প্রকাশিত হয়েছে।
সুবিধা এবং উদ্বেগের দ্বৈত চিত্র
গবেষণায় ২২ জন হোটেল ম্যানেজার ও শিক্ষা বিশেষজ্ঞের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে, যেখানে এএম-এর ব্যবহার সম্পর্কে তাদের মতামত উঠে এসেছে। অংশগ্রহণকারীরা অ্যালগরিদমিক ম্যানেজমেন্টের সুবিধা এবং উদ্বেগ – উভয় দিকই তুলে ধরেছেন। একদিকে যেমন এই সিস্টেমগুলো কাজের সক্ষমতা বাড়িয়ে কর্মীদের উপর চাপ কমাতে সাহায্য করতে পারে, তেমনই এর কিছু নেতিবাচক দিকও রয়েছে।
গবেষণায় উঠে এসেছে যে, এই প্রযুক্তি হোটেলের কর্মীদের মধ্যে এক ধরণের বিচ্ছিন্নতা এবং একাকিত্ব তৈরি করতে পারে। কর্মীরা মনে করতে পারেন যে, তাদের আর মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন করা হচ্ছে না, বরং তারা কেবল ডেটা বা সংখ্যায় পরিণত হয়েছেন। যদি এই পরিবর্তনগুলো সঠিক পরিকল্পনা এবং সংবেদনশীলতার সাথে বাস্তবায়ন না করা হয়, তাহলে কর্মীদের মনোবল কমে যেতে পারে, তারা কাজের প্রতি উৎসাহ হারাতে পারেন এবং হোটেল ব্যবস্থাপনার সঙ্গে তাদের একটি দূরত্ব তৈরি হতে পারে।
ম্যানেজারদের নতুন ভূমিকা: নিয়ন্ত্রক থেকে পথপ্রদর্শক
এই পরিবর্তন সত্ত্বেও ব্রানা জিয়ানু জোর দিয়ে বলেছেন যে, হোটেল ম্যানেজাররা অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ছেন না, তবে তাদের কাজের ভূমিকা নিশ্চিতভাবেই বদলাচ্ছে। এখন আর তাদের কেবল নির্দেশ জারি করা বা কর্মীদের কাজের তদারকি করাই যথেষ্ট হবে না। বরং তাদের একজন পথপ্রদর্শক বা গাইডের মতো আচরণ করতে হবে। এর অর্থ হলো, দলের সদস্যদের প্রয়োজনীয় সহায়তা দেওয়া, তাদের নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে মানিয়ে নিতে শেখানো ও উৎসাহিত করা, কর্মীদের মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাস গড়ে তোলা এবং সবাইকে একসঙ্গে একটি লক্ষ্য অর্জনের দিকে চালিত করা।
গবেষকরা মনে করছেন, নতুন এই এআই-নির্ভর পরিবেশে কাজ করার জন্য কর্মীদের কগনিটিভ ইন্টেলিজেন্স বা জ্ঞানীয় বুদ্ধিমত্তা এবং শক্তিশালী যোগাযোগ দক্ষতা গড়ে তোলা অত্যন্ত প্রয়োজন।
গবেষণার মূল বার্তা হলো, হোটেল ব্যবস্থাপনার ভবিষ্যৎ মানুষ বনাম মেশিন – এই দুইয়ের মধ্যে একটিকে বেছে নেওয়ার বিষয়ে নয়। বরং আসল চ্যালেঞ্জ হলো, মানুষ এবং মেশিন কীভাবে একসঙ্গে আরও ভালোভাবে কাজ করতে পারে, সেই সমন্বয় খুঁজে বের করা। কারণ, এআই যতই এই খাতটিকে পরিবর্তন করুক না কেন, সত্যিকারের এবং আন্তরিক আতিথেয়তার জন্য মানুষের স্পর্শ বা মানবিক দিকটির গুরুত্ব এখনও অপরিসীম।