হিউম্যানয়েড রোবট তৈরির দৌড়ে কে এগিয়ে? জেনেনিন কতটা এগোচ্ছে এই নয়া প্রযুক্তি?

হ্যানোভার মেস-এ নজর কাড়ল চিনা হিউম্যানয়েড রোবট ‘জি-১’, সাশ্রয়ী মূল্যের এই যন্ত্র কি বদলাবে শিল্প ও গৃহস্থালীর ভবিষ্যৎ?

হ্যানোভার, জার্মানি: জার্মানির হ্যানোভার শহরে অনুষ্ঠিত বিশ্বের অন্যতম বড় শিল্প-বাণিজ্য প্রদর্শনী ‘হ্যানোভার মেস’-এ এবার দর্শনার্থীদের বিশেষ আকর্ষণ ছিল একটি যন্ত্রমানব। প্রদর্শনীতে চিনা কোম্পানি ‘ইউনিট্রি’র তৈরি ‘জি-১’ নামের একটি হিউম্যানয়েড রোবট দেখানো হয়েছে, যা তার ছোট আকার, সাশ্রয়ী মূল্য এবং ব্যতিক্রমী সক্ষমতা দিয়ে নজর কেড়েছে।

প্রায় ৪ ফুট ৩ ইঞ্চি বা ১৩০ সেমি উচ্চতার এই রোবটটি বাজারে বিদ্যমান অন্যান্য হিউম্যানয়েড রোবটের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে ছোট ও সাশ্রয়ী মূল্যের। বিবিসির প্রতিবেদন অনুযায়ী, এর গতি ও সক্ষমতা এতটাই ভালো যে এরইমধ্যে রোবটটির নাচ ও মার্শাল আর্টের ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়ার খবর উঠে এসেছে। প্রদর্শনীতে ইউনিট্রি’র সেলস ম্যানেজার পেড্রো ঝেং রিমোটের মাধ্যমে রোবটটিকে নিয়ন্ত্রণ করছিলেন। তিনি জানান, গ্রাহকদের অবশ্যই প্রতিটি জি ১ রোবটকে তাদের নিজস্ব চাহিদা অনুযায়ী অটোনমাস ফাংশনের জন্য আলাদাভাবে প্রোগ্রাম করতে হবে। ইউনিট্রি বিশ্বজুড়ে এমন কয়েক ডজন কোম্পানির মধ্যে একটি যারা মানুষের মতো দেখতে রোবট তৈরি করার প্রতিযোগিতায় নেমেছে।

ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ

এসব হিউম্যানয়েড রোবটের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা বিশাল। বিশেষ করে ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে এরা এমন এক কর্মী শক্তির সুবিধা দিতে পারে, যাদের ছুটির দিন বা বেতন বৃদ্ধির মতো বিষয়গুলো অপ্রাসঙ্গিক। গৃহস্থালীর কাজের জন্যও এসব রোবট অত্যন্ত কার্যকর হতে পারে; কে না চায় যে, এমন একটি মেশিন থাকবে, যা কাপড় ধোয়া থেকে শুরু করে ঘরের প্রায় সব কাজ করে দেবে?

কিন্তু এমন প্রযুক্তি ব্যাপকহারে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছতে এখনও কিছুটা সময় লাগবে। কয়েক দশক ধরে বিভিন্ন কারখানাতে রোবোটিক আর্ম ও মোবাইল রোবট ব্যবহার করা হলেও, সেসব কাজের ক্ষেত্র নির্দিষ্ট পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা ও কর্মীদের নিরাপদ রাখার মধ্যে সীমাবদ্ধ। রেস্তোরাঁ বা বাড়ির মতো আরও জটিল ও অনিয়ন্ত্রিত পরিবেশে হিউম্যানয়েড রোবটকে পুরোপুরি কার্যকরী করে তোলা অনেক বেশি কঠিন। দরকারি কাজ সম্পন্ন করার জন্য এসব হিউম্যানয়েড রোবটকে যথেষ্ট শক্তিশালী হতে হবে, তবে এই শক্তিই আবার এদের সম্ভাব্য বিপজ্জনক করে তুলতে পারে। আর এমন একটি জটিল যন্ত্রকে নিরাপদে নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই নিয়ে অনেক গবেষণা ও কাজ করা দরকার বলে বিশেষজ্ঞরা উল্লেখ করছেন।

ইউনিট্রি’র একজন মুখপাত্র এই প্রসঙ্গে বলেছেন, “এআই এখনও যুগান্তকারী পর্যায়ে পৌঁছায়নি। বর্তমানের প্রচলিত রোবট কেবল এআইয়ের মৌলিক যুক্তি খুঁজে পেয়েছে। যেমন যৌক্তিক উপায়ে জটিল বিভিন্ন কাজ বোঝা, তবে এসব কাজ এদের মাধ্যমে শেষ করার বিষয়টি এখনও চ্যালেঞ্জিং।”

বাজার ও প্রতিযোগিতা

এই মুহূর্তে ইউনিট্রি’র জি ১ রোবটটি মূলত গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন প্রযুক্তি কোম্পানিতে বাজারজাত করা হচ্ছে। এর সুযোগ পাচ্ছেন কেবল যারা উন্নয়নের জন্য ইউনিট্রি’র ওপেন সোর্স সফটওয়্যার ব্যবহার করতে পারেন। বিশ্বজুড়ে উদ্যোক্তারা আপাতত গুদাম ও কারখানার মতো নির্দিষ্ট পরিবেশের জন্য বিভিন্ন হিউম্যানয়েড রোবট তৈরির ওপর মনোযোগ দিয়েছেন।

এই প্রতিযোগিতায় বেশ কিছু বড় নাম সামিল হয়েছে। ইলন মাস্কের গাড়ি কোম্পানি টেসলা ‘অপ্টিমাস’ নামের এক হিউম্যানয়েড রোবট তৈরি করেছে এবং মাস্ক বলেছেন যে এ বছর তারা ‘কয়েক হাজার’ রোবট তৈরি করবেন যা টেসলার কারখানার জন্য ‘কার্যকর জিনিস’ হয়ে উঠবে। অন্যান্য গাড়ি নির্মাতা যেমন বিএমডব্লিউ সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের একটি কারখানায় হিউম্যানয়েড রোবট এনেছে। এদিকে, ২০২১ সালে কেনা রোবট প্রতিষ্ঠান বস্টন ডায়নামিক্সের কাছ থেকে এর মালিক কোম্পানি হুন্দাই কয়েক হাজার রোবটের অর্ডার দিয়েছে।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘এসটিআইকিউ’-এর প্রতিষ্ঠাতা টমাস অ্যান্ডারসন হিউম্যানয়েড রোবট তৈরি করে এমন ৪৯টি কোম্পানির ওপর নজর রাখেন। অ্যান্ডারসনের ধারণা, হিউম্যানয়েড রোবট তৈরিতে বাজারে আধিপত্য বিস্তার করতে পারে বিভিন্ন চীনা কোম্পানি। তিনি বলেছেন, “চীনে রোবোটিক্সের সরবরাহ চেইন ও পুরো বাস্তুতন্ত্র বিশাল আকারের এবং দেশটিতে রোবট বিকাশ ও গবেষণার কাজটি সত্যিই সহজ।” সেই সুবিধাটি কাজে লাগিয়ে ইউনিট্রি তাদের সাশ্রয়ী মূল্যের জি ১ রোবট তৈরি করতে পেরেছে, যার দাম ১৬ হাজার ডলার।

অ্যান্ডারসন আরও বলেছেন যে এই খাতে বিনিয়োগ বর্তমানে এশিয়ার বিভিন্ন দেশের অনুকূলে। সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে এসটিআইকিউ বলেছে, হিউম্যানয়েড রোবটের জন্য প্রায় ৬০ শতাংশ অনুদান এশিয়া থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে, বাকিরা বেশিরভাগই অনুদান নিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। এছাড়াও, জাতীয় ও স্থানীয় সরকারের সহায়তার বাড়তি সুবিধা রয়েছে চীনা বিভিন্ন কোম্পানির। যেমন– দেশটির সাংহাইতে রোবটের জন্য রাষ্ট্রসমর্থিত এক প্রশিক্ষণ সুবিধা রয়েছে, যেখানে কয়েক ডজন হিউম্যানয়েড রোবট কাজ শিখছে।

তাহলে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের রোবট নির্মাতারা কীভাবে এর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করবে? ব্রিস্টলের বাসিন্দা ব্রেন পিয়ার্স তিনটি রোবোটিক্স কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেছেন। তার কোম্পানি ‘কিনিসি রোবোটিক্স’ তাদের সর্বশেষ ‘কেআর ১’ নামের রোবট আনছে, যা গুদাম ও কারখানার জন্য ডিজাইন করা। রোবটটি যুক্তরাজ্যে ডিজাইন ও ডেভেলপ করা হলেও এটি এশিয়ায় তৈরি হবে। পিয়ার্স বলেছেন, ইউরোপীয় বা আমেরিকান কোম্পানি হিসেবে রোবট তৈরির সকল উপাদান প্রাথমিকভাবে চীন থেকেই কিনতে হয়, তাই এশিয়ায় এগুলো তৈরি করাই বুদ্ধিমানের কাজ। এশিয়ায় রোবট তৈরির পাশাপাশি পুরো হিউম্যানয়েড ধরনের রোবট না বানিয়ে (যেমন কেআর ১ রোবটটির পা নেই) খরচ কমিয়ে রাখছেন পিয়ার্স। তার মতে, আসল ‘গোপন রহস্য’ হচ্ছে সফটওয়্যার, যা রোবটকে মানুষের সঙ্গে কাজ করতে সাহায্য করে। এ বছর পরীক্ষার জন্য পাইলট গ্রাহকদের কেআর ১ দেওয়া হবে।

তাহলে কি রোবটরা কখনো কারখানা থেকে ঘরে ঢুকবে? এমন প্রশ্নে পিয়ার্স বলেছেন, এটি এখনও অনেক দূরে। কম করে হলেও ১০ থেকে ১৫ বছর দূরে।

হ্যানোভার মেস-এর মতো প্রদর্শনীগুলো হিউম্যানয়েড রোবোটিক্সের দ্রুত অগ্রগতির প্রমাণ। সম্ভাবনা বিশাল হলেও প্রযুক্তিগত ও ব্যবহারিক চ্যালেঞ্জ এখনও রয়ে গেছে। বিশ্বজুড়ে কোম্পানিগুলো এই প্রতিযোগিতায় সামিল হয়েছে, যেখানে চীন সাপ্লাই চেইন ও সরকারি সহায়তার কারণে একটি শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। ভবিষ্যৎ বলবে, এই যন্ত্রগুলো সত্যিই আমাদের শিল্প ও দৈনন্দিন জীবনকে কতটা পরিবর্তন করতে পারে।