মঙ্গলে হারিয়ে যাওয়া বায়ুমণ্ডলের সূত্র দিল কিউরিওসিটি রোভার, জানালো নাসা

মঙ্গল গ্রহ একসময় উষ্ণ, আর্দ্র এবং সম্ভবত প্রাণের বাসযোগ্য ছিল বলে বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন। কিন্তু কী কারণে গ্রহটি তার ঘন বায়ুমণ্ডল হারিয়েছে এবং এত শুষ্ক ও প্রাণহীন হয়ে পড়েছে, তা ছিল এক দীর্ঘদিনের রহস্য। এবার যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার পাঠানো কিউরিওসিটি রোভার মঙ্গল গ্রহের হারিয়ে যাওয়া বায়ুমণ্ডলের সেই সূত্র উন্মোচন করেছে।

নাসার বিজ্ঞানীরা দাবি করছেন, কিউরিওসিটি রোভারের এই নতুন আবিষ্কার মঙ্গলের প্রাচীন বায়ুমণ্ডলে কী ঘটেছিল এবং কেন গ্রহটি বর্তমান রূপে দাঁড়িয়েছে, তা ব্যাখ্যা করতে গুরুত্বপূর্ণ সাহায্য করবে। বহু বছর ধরে বিজ্ঞানীদের অনুমান ছিল যে, আদি মঙ্গলের কার্বন ডাই অক্সাইডের একটি ঘন বায়ুমণ্ডল ছিল এবং এর পৃষ্ঠে তরল জল প্রবাহিত হতো। এমন পরিস্থিতিতে বাতাসে থাকা কার্বন ডাই অক্সাইড ও জল মঙ্গলের বিভিন্ন শিলার সঙ্গে রাসায়নিক বিক্রিয়া করে কার্বনেট নামক এক ধরনের খনিজ তৈরি করার কথা।

তবে বিস্ময়করভাবে, এত দিন পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা মঙ্গলে এই তত্ত্বের সমর্থনে পর্যাপ্ত কার্বনেটের উপস্থিতি খুঁজে পাচ্ছিলেন না। বিজ্ঞানভিত্তিক জার্নাল ‘সায়েন্স’-এ প্রকাশিত নতুন এক গবেষণায় সেই রহস্যের সমাধান হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।

গবেষকরা কিউরিওসিটি রোভারের সংগ্রহ করা তথ্যের ভিত্তিতে মঙ্গলের ‘গেইল’ গর্তে অবস্থিত ‘মাউন্ট শার্প’ নামের একটি স্থানের তিনটি ড্রিল সাইটের নমুনা বিশ্লেষণ করেছেন। সেখানেই তারা ‘সাইডারাইট’ নামের এক বিশেষ ধরনের কার্বনেট খনিজ আবিষ্কার করেছেন, যার মধ্যে লোহা রয়েছে। বিজ্ঞানভিত্তিক সাইট নোরিজের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই খনিজটি সালফেটযুক্ত শিলার বিভিন্ন স্তরে পাওয়া গেছে। বিজ্ঞানীদের অনুমান, এগুলো প্রায় সাড়ে তিনশ কোটি বছর আগে মঙ্গল পৃষ্ঠের কাছাকাছি গঠিত হয়েছিল।

গবেষকরা বলছেন, কঠিন খনিজ আকারে মঙ্গলে কার্বনেটের উপস্থিতির এটিই প্রথম শক্তিশালী প্রমাণ। এই আবিষ্কার ইঙ্গিত দেয় যে, মঙ্গলে একসময় সত্যিই একটি ঘন কার্বন ডাই-অক্সাইডের বায়ুমণ্ডল ছিল, যা গ্রহটিকে উষ্ণ রাখতে এবং এর পৃষ্ঠে তরল জলের অস্তিত্ব বজায় রাখার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

গবেষকরা এই আবিষ্কারকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে বর্ণনা করেছেন। কারণ, জীবনের জন্য পানি অপরিহার্য, এবং মঙ্গলে পানির অতীতের প্রমাণ খুঁজে পাওয়া বিজ্ঞানীদের বুঝতে সাহায্য করবে যে সেখানে একসময় প্রাণের অস্তিত্ব থাকা সম্ভব ছিল কিনা। ইউনিভার্সিটি অফ শিকাগোর গবেষক এবং এই গবেষণার অন্যতম লেখক ড. এডউইন কাইট বলেছেন, “পৃথিবী ও মঙ্গল গ্রহ একসময় একইরকম ছিল। কিন্তু কেন এরা এত ভিন্ন পথে গিয়েছিল সে সম্পর্কেও ধারণা দিয়েছে এই আবিষ্কার।” পৃথিবী কোটি কোটি বছর ধরে বসবাসের উপযোগী থাকলেও মঙ্গল দিন দিন ঠাণ্ডা ও অনুর্বর হয়ে উঠেছে।

কিউরিওসিটি রোভার মঙ্গল পৃষ্ঠের প্রায় এক থেকে দেড় ইঞ্চি গভীর ছোট গর্ত ড্রিল করে পাথরের গুঁড়া সংগ্রহ করে এই আবিষ্কার সম্ভব করেছে। এরপর ‘চেমিন’ (CheMin) নামের একটি যন্ত্র ব্যবহার করে রোভারের ভেতরেই সংগৃহীত নমুনা বিশ্লেষণ করা হয়। চেমিন যন্ত্রটি এক্স-রে ব্যবহার করে খনিজ পদার্থ শনাক্ত করে।

নাসার বিজ্ঞানী টমাস ব্রিস্টো বলেছেন, “গ্রহটির পৃষ্ঠে ড্রিল করার বিষয়টি অনেকটা মঙ্গলের ইতিহাস বইয়ের পাতা পড়ার মতো। কেবল কয়েক সেন্টিমিটার নিচে বিজ্ঞানীরা দেখতে পাচ্ছেন কোটি কোটি বছর আগে মঙ্গলের পরিস্থিতি কেমন ছিল।”

এর আগে কক্ষপথ থেকে ইনফ্রারেড স্যাটেলাইট ব্যবহার করে কার্বনেট অনুসন্ধানের চেষ্টা করতেন বিজ্ঞানীরা। কিন্তু সেইসব যন্ত্র অন্যান্য পদার্থের নীচে লুকানো বিভিন্ন খনিজ শনাক্ত করতে পারত না। সম্ভবত এ কারণেই কিউরিওসিটি শিলাতে ড্রিল না করা পর্যন্ত কার্বনেটযুক্ত এই গুরুত্বপূর্ণ খনিজটি এতদিন শনাক্ত করা যায়নি।

ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালগেরির প্রধান লেখক ড. বেঞ্জামিন টুটোলো এই আবিষ্কারকে ‘বিস্ময়কর ও গুরুত্বপূর্ণ উভয়ই’ বলে বর্ণনা করেছেন। তার মতে, এটি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মঙ্গল গ্রহের বায়ুমণ্ডল কীভাবে ধীরে ধীরে পাথরে রূপান্তরিত হয়েছে, তার একটি স্পষ্ট চিত্র দিয়েছে।

এই আবিষ্কার মঙ্গলের ভূতাত্ত্বিক ইতিহাস, তার বায়ুমণ্ডলীয় বিবর্তন এবং সম্ভাব্য প্রাণের অতীত অস্তিত্ব সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানকে আরও সমৃদ্ধ করবে।