
রাতের আকাশে এখন শুধু স্টারলিংক স্যাটেলাইটের আলোর রেখা নয়, খুব শীঘ্রই সেখানে চীনের নিজস্ব ইন্টারনেট স্যাটেলাইটগুলোরও দেখা মিলবে। ইলন মাস্কের স্পেসএক্স-এর স্টারলিংকের মতো চীনও পৃথিবীর নিম্ন কক্ষপথের জন্য বিশাল আকারের স্যাটেলাইট গুচ্ছ তৈরি করছে এবং সেগুলো মহাকাশে পাঠানোও শুরু করেছে। গত আগস্ট থেকে এখন পর্যন্ত চীন একশটির বেশি স্যাটেলাইট মহাকাশে পাঠিয়েছে, যা তাদের বিশাল স্যাটেলাইট গুচ্ছের প্রথম ব্যাচ। চীন মোট ২৮ হাজার স্যাটেলাইট নিয়ে দুটি দল তৈরি করছে, যা স্টারলিংকের জন্য এক বড় চ্যালেঞ্জ হতে চলেছে।
চীনের এই দুটি স্যাটেলাইট প্রকল্পের নাম ‘গুয়োওয়াং’ (Guowang) ও ‘চিয়ানফান’ (Qianfan)। যদিও তাদের কর্পোরেট কাঠামো ও ভাষার পার্থক্যের কারণে ইংরেজিতে এগুলোর বিভিন্ন বিকল্প নামও রয়েছে, যা কিছুটা বিভ্রান্তিকর। প্রথম প্রকল্পটি ‘সিংওয়াং’ বা ‘স্যাটনেট’ নামেও পরিচিত এবং এটি মূলত অভ্যন্তরীণ টেলিযোগাযোগ ও জাতীয় নিরাপত্তার জন্য কাজ করছে।
অন্যদিকে, দ্বিতীয় প্রকল্পটি ‘স্পেসসেইল’ (SpaceSail) বা এসএসএসটি নামে পরিচিত, যা বিদেশি বিভিন্ন টেলিকম কোম্পানির জন্য সেবা দিতে বেশি মনোযোগী। ইতিমধ্যেই ব্রাজিল, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডের সঙ্গে চুক্তি করেছে চিয়ানফান এবং এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার আরও কয়েক ডজন বাজারে প্রবেশের পরিকল্পনা রয়েছে তাদের।
স্টারলিংকের সঙ্গে প্রতিযোগিতা: চীনের সুবিধা ও চ্যালেঞ্জ
বর্তমানে পৃথিবীর নিম্ন কক্ষপথে সাত হাজারেরও বেশি স্টারলিংক স্যাটেলাইট রয়েছে, যার তুলনায় চীন স্পষ্টতই পিছিয়ে আছে। তবে, গুয়োওয়াং ও চিয়ানফান এখন এমন এক দলে যোগ দিয়েছে যারা বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় স্টারলিংকের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে নিজেদের কার্যক্রম বাড়িয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত এই বাজারের প্রধান প্রতিযোগীকেও চ্যালেঞ্জ করতে পারে।
‘স্মিথসোনিয়ান অ্যাস্ট্রোফিজিক্যাল অবজারভেটরি’র জ্যোতির্বিজ্ঞানী এবং বিশ্বজুড়ে স্যাটেলাইট গুচ্ছের ট্র্যাক রাখা জোনাথন ম্যাকডুয়েল বলেছেন, “২০২৩ ও ২০২৪ সাল ছিল স্টারলিংক স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের বছর। আর ২০২৫ সাল হলো এই বাজারে অন্যদের মাঠে নামার বছর।” তিনি আরও উল্লেখ করেছেন, “পশ্চিমে আমরা চীনের বাণিজ্যিক মহাকাশ শিল্প সম্পর্কে খুব কমই জানি বা গুরুত্ব দিই।”
নতুন আসা চীনের এই স্যাটেলাইট কোম্পানি কিছু বিশেষ সুবিধা পেতে পারে। কারণ, মার্কিন রাজনীতির সঙ্গে ইলন মাস্কের গভীর সম্পৃক্ততার বিষয়টি তার মহাকাশ কোম্পানি স্পেসএক্স-এর স্টারলিংকের সুনাম ও নিরাপত্তার জন্য বৈশ্বিক ঝুঁকি তৈরি করছে বলে ‘উইয়ার্ড’ (Wired) ম্যাগাজিনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ২০২৩ সালে ইউক্রেনে রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধের মাঝখানে মাস্ক স্টারলিংক সেবা সীমিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
তবে, গুয়োওয়াং ও চিয়ানফান যখন তাদের প্রথম দফার স্যাটেলাইট মহাকাশে পাঠাচ্ছে, তখনই নানা সমস্যায় পড়েছে তারা। এর মধ্যে রয়েছে স্পেসএক্সের তুলনায় বেশি সংখ্যক ত্রুটিপূর্ণ স্যাটেলাইট, প্রশাসনিক জটিলতা ও সীমিত রকেট উৎক্ষেপণ সক্ষমতা। শিগগিরই যদি চীন পর্যাপ্ত সংখ্যক স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করতে না পারে, তাহলে জাতিসংঘের অধীনে মহাকাশ যোগাযোগ সমন্বয় সংস্থা ‘ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়ন’ (ITU) তাদের পরিকল্পিত স্যাটেলাইট সংখ্যা কমিয়ে আনতে বলতেও পারে।
ত্রুটিপূর্ণ স্যাটেলাইট ও মহাকাশ বর্জ্যের ঝুঁকি
গত মাস পর্যন্ত চিয়ানফান ৯০টি স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করেছে, যা ভূমিতে থাকা ব্যবহারকারীদের জন্য ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবা দেবে। অন্যদিকে, গুয়োওয়াং উৎক্ষেপণ করেছে ২৯টি স্যাটেলাইট। যদিও চিয়ানফান কিছুটা এগিয়ে, তাদের বিভিন্ন স্যাটেলাইটের মধ্যে তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি ত্রুটিপূর্ণ হওয়ার আশঙ্কা দেখা যাচ্ছে, যা অন্যান্য একইরকম প্রকল্পের তুলনায় উদ্বেগজনক।
জোনাথন ম্যাকডুয়েল বলেছেন, চিয়ানফান এখন পর্যন্ত যে ৯০টি স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করেছে, তার মধ্যে ১৩টির অস্বাভাবিক আচরণ দেখা গিয়েছে। এসব স্যাটেলাইট তাদের অন্যান্য সঙ্গীদের সঙ্গে কক্ষপথে নির্ধারিত উচ্চতায় পৌঁছাতে পারেনি। চিয়ানফানের দ্বিতীয় ব্যাচ, যা অক্টোবর ২০২৪-এ উৎক্ষেপণ করা হয়েছে, তাতে থাকা ১৮টি স্যাটেলাইটের মধ্যে কেবল ৫টি পরিকল্পিত উচ্চতায় পৌঁছাতে পেরেছিল।
আরেকটি বড় সমস্যা হচ্ছে, চিয়ানফান ও গুয়োওয়াং প্রকল্প দুটি স্টারলিংকের তুলনায় বেশি উচ্চতায় স্যাটেলাইট পাঠাচ্ছে। ফলে যদি কোনো স্যাটেলাইট কাজ করতে না পারে, তাহলে সেটিকে কক্ষপথ থেকে সরানো আরও কঠিন হয়ে পড়ছে এবং এ বিষয়টি দীর্ঘমেয়াদি মহাকাশ আবর্জনায় পরিণত হওয়ার আশঙ্কা বাড়িয়ে তুলছে।
ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব ও আন্তর্জাতিক বাজার
গুয়োওয়াং ও চিয়ানফান এখন পর্যন্ত একে অপরের সঙ্গে সরাসরি প্রতিযোগিতা করার বিষয়টি এড়িয়ে চলেছে, কারণ তারা ভিন্ন ভিন্ন বাজারকে টার্গেট করেছে। গুয়োওয়াং চীনের কেন্দ্রীয় সরকারের বেশি সমর্থন পাচ্ছে এবং এটিকে জাতীয় নিরাপত্তা সম্পর্কিত কাজে ব্যবহারের দায়িত্ব দেওয়া হতে পারে। গত মাসে প্রকাশিত ‘অ্যাটলান্টিক কাউন্সিল’-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তাইওয়ান গোয়েন্দা তথ্য বলছে, গুয়োওয়াং স্যাটেলাইট পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগর এলাকায় কার্যকরভাবে কাজ করে কি না ও সম্ভাব্য মিসাইল হামলায় দিকনির্দেশনা দিতে পারে কি না – তা যাচাইয়ের চেষ্টা করছে চীনের বিভিন্ন সামরিক মহড়া।
অন্যদিকে, চিয়ানফান নিজেকে আন্তর্জাতিক বাজারে স্টারলিংকের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে গড়ে তুলতে কাজ করছে। চীনের এক মহাকাশ শিল্প সম্মেলনে চিয়ানফানের প্রতিনিধির উপস্থাপিত এক মানচিত্রে উঠে এসেছে, ইতিমধ্যেই ব্রাজিল, কাজাখস্তান, মালয়েশিয়া, ওমান, পাকিস্তান ও উজবেকিস্তান অর্থাৎ ছয়টি বাজারে কাজ শুরু করেছে তারা। ওই মানচিত্রে আরও দেখানো হয়েছে, ২০২৫ সালে আরও দুই ডজন দেশের বাজারে প্রবেশের পরিকল্পনা করছে চিয়ানফান, যার মধ্যে রয়েছে ভারত, সৌদি আরব, ইরান, আর্জেন্টিনা ও আফ্রিকার অনেক দেশ।
কিছু দেশ স্টারলিংকের ওপর মাস্কের রাজনৈতিক কার্যকলাপ ও তার প্রভাব নিয়ে ক্রমাগত সন্দিহান হয়ে উঠছে। এ কারণে, আন্তর্জাতিক বাজারে চিয়ানফান সুবিধা পেতে পারে। স্টারলিংকের নতুন স্যাটেলাইটগুলোয় এমন সুবিধা রয়েছে, যার ফলে এদের ডেটা স্থানীয় ইন্টারনেট গেটওয়ের মাধ্যমে না গিয়ে সরাসরি স্যাটেলাইটের মাধ্যমে চলে যায়। এই বিষয়টি কিছু দেশকে উদ্বিগ্ন করতে পারে, বিশেষ করে যারা স্থানীয় ইন্টারনেট ডেটার ওপর আরও নিয়ন্ত্রণ রাখতে চায়।
বিশ্বজুড়ে ইন্টারনেট স্যাটেলাইট গুচ্ছের এই তীব্র প্রতিযোগিতা মহাকাশ প্রযুক্তি এবং ভূ-রাজনৈতিক সমীকরণে কী ধরনের পরিবর্তন আনবে, তা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।