লিথিয়াম সংগ্রহে হিমশিম খেতে হবে আমেরিকা, চীন, ইউরোপকে, জেনেনিন কেন?

বৈদ্যুতিক গাড়ির (ইভি) ভবিষ্যৎ কি লিথিয়াম সংকটে পড়তে চলেছে? সাম্প্রতিক এক গবেষণা তেমনটাই ইঙ্গিত দিচ্ছে। ব্রিটিশ দৈনিক দ্য ইন্ডিপেনডেন্টের খবর অনুযায়ী, সাংহাইয়ের ইস্ট চায়না নরমাল ইউনিভার্সিটি এবং সুইডেনের লুন্ড ইউনিভার্সিটির গবেষকরা একটি ‘লুমিং ক্রাইসিস’ বা আসন্ন সংকটের কথা তুলে ধরেছেন, যা ‘বৈশ্বিক জলবায়ু ও জ্বালানি লক্ষ্যমাত্রা’ পূরণে বিলম্ব ঘটাতে পারে। বিশ্বের প্রধান ইভি বাজারগুলো—ইউরোপ, চীন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র—পর্যাপ্ত লিথিয়াম উৎপাদনে হিমশিম খাবে বলে এই গবেষণায় সতর্ক করা হয়েছে।

চাহিদার সঙ্গে পাল্লা দিতে ব্যর্থ উৎপাদন
গবেষণায় বলা হয়েছে, ২০৩০ সালের মধ্যে এই অঞ্চলগুলোতে অভ্যন্তরীণ লিথিয়াম উৎপাদন দশগুণ বাড়ার সম্ভাবনা থাকলেও, তা দ্রুত বাড়তে থাকা চাহিদা মেটাতে যথেষ্ট হবে না। এর প্রধান কারণ, প্রযুক্তিগত অগ্রগতি বা আমদানি বৃদ্ধি যদি না ঘটে, তবে এই দেশগুলো নিজেদের ক্রমবর্ধমান বিদ্যুচ্চালিত গাড়ির ব্যাটারির জন্য প্রয়োজনীয় লিথিয়াম জোগাড় করতে পারবে না।

লিথিয়াম, যা বেশিরভাগ বিদ্যুচ্চালিত গাড়ির ব্যাটারির অপরিহার্য উপাদান, মূলত খনি থেকে পাওয়া যায়। সড়ক পরিবহনে কার্বন নিঃসরণ কমাতে ইভি-কে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়, যার ফলে ইউরোপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন জুড়ে ইভির চাহিদা হু হু করে বাড়ছে। এ বছরের প্রথম পাঁচ মাসে, ব্যাটারি চালিত বৈদ্যুতিক গাড়ি বাজারের ২০.৯% দখল করেছে, যা গত বছরের একই সময়ের ১৬.১% থেকে বেশি। ২০৩০ সাল থেকে যুক্তরাজ্যে পেট্রোল এবং ডিজেল চালিত গাড়ি বিক্রি নিষিদ্ধ করার পরিকল্পনা রয়েছে, যা ইভির চাহিদা আরও বাড়াবে।

আমদানির ওপর বাড়তি চাপ
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইউরোপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন, যেখানে বিশ্বের ৮০% বিদ্যুচ্চালিত গাড়ি বিক্রি হয়, তারা ভবিষ্যতের লিথিয়াম উৎপাদনের মাত্রা এবং প্রয়োজনীয় পরিমাণের চাহিদা পূরণ করতে পারবে না। ফলে এই দেশগুলোকে অন্যান্য দেশ থেকে লিথিয়াম আমদানি করতে হবে।

গবেষকদের অনুমান, ২০৩০ সালের মধ্যে ইউরোপে ৭ লক্ষ ৯২ হাজার মেট্রিক টন লিথিয়ামের প্রয়োজন হতে পারে। বর্তমান এবং প্রস্তাবিত লিথিয়াম খনির প্রকল্পের উপর ভিত্তি করে, সেই সময়ে ইউরোপে উৎপাদন মাত্র ৩ লক্ষ ২৫ হাজার মেট্রিক টনে পৌঁছাতে পারে। এই বিপুল ঘাটতি মেটানো এক বড় চ্যালেঞ্জ।

সংকট মোকাবিলায় বিকল্প পথ
এই সংকট থেকে বাঁচার জন্য গবেষণায় কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দেওয়া হয়েছে:

গণপরিবহনে জোর: ব্যক্তিগত বিদ্যুচ্চালিত গাড়ি উৎপাদন থেকে মনোযোগ সরিয়ে গণপরিবহন ব্যবহারের প্রচারের দিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত।
বিকল্প ব্যাটারি প্রযুক্তি: কম বা একেবারেই লিথিয়াম ব্যবহার করে না, এমন ব্যাটারি প্রযুক্তি গ্রহণ করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
যুক্তরাজ্য বর্তমানে চীন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলো থেকে লিথিয়াম আমদানি করে। তবে, বেশ কয়েকটি কোম্পানি কর্নওয়াল এবং ইংল্যান্ডের উত্তর-পূর্বে লিথিয়াম উত্তোলনের পরিকল্পনা করছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য দেশগুলির মধ্যে পর্তুগালই একমাত্র দেশ, যারা খনি থেকে লিথিয়াম উত্তোলন ও প্রক্রিয়াজাত করে।

সেল রিপোর্টস সাসটেইনেবিলিটি জার্নালে প্রকাশিত এই গবেষণার লেখক কিফান জিয়া বলেছেন, “শিল্প বিপ্লবের সময় পেট্রোলের মতোই আজ লিথিয়াম গুরুত্বপূর্ণ। যদিও বিশ্বজুড়ে লিথিয়ামের মজুদ যথেষ্ট, তবু বিভিন্ন দেশে তা অসমভাবে বিতরণ করা হয়।” তিনি আরও যোগ করেন, “খনি সম্প্রসারণ, সরবরাহকারীদের বৈচিত্র্য আনা এবং চাহিদা কীভাবে পরিচালনা করা যায় তা নিয়ে নতুন করে না ভাবলে বিশ্ব জলবায়ু এবং শক্তি চাহিদার লক্ষ্য পূরণে ঝুঁকিতে পড়বে।”

নিউ অটোমোটিভের প্রতিষ্ঠাতা বেন নেলমেস মন্তব্য করেছেন, “লিথিয়াম অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হবে। তাই ইউরোপীয় নীতিনির্ধারকদের জন্য বৈদ্যুতিক গাড়ির উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য এবং খনির প্রকল্পের জন্য সহায়ক পরিবেশ বজায় রেখে বিনিয়োগকারীদের কাছে ইতিবাচক সংকেত পাঠানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।” সংস্থাটির আলাদা কয়েকটি বিশ্লেষণে অনুমান করা হয়েছে, আগামী পাঁচ বছরে বিদ্যুচ্চালিত গাড়ির ব্যাটারি উৎপাদন এবং সরবরাহের মাধ্যমে ইউরোপে আড়াই লক্ষ কর্মসংস্থান তৈরি হতে পারে।

এই গবেষণাটি ইভি শিল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে এক নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। লিথিয়াম সংকটের সমাধান না হলে বৈশ্বিক কার্বন নিঃসরণ কমানোর লক্ষ্য অর্জন কঠিন হয়ে পড়বে।

Related Posts

© 2025 Tech Informetix - WordPress Theme by WPEnjoy