মহাবিশ্ব অসীম ও রহস্যময়। স্বভাবতই মহাবিশ্ব নিয়ে বিজ্ঞানী ও আমাদের আগ্রহের কোনো শেষ নেই। সেই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি মহাবিশ্ব গঠনের রহস্য উন্মোচন করেছে ‘ক্রিসমাস ট্রি’র মতো দেখতে এক ছায়াপথ।
গঠনের সময় ছায়াপথ দেখতে কেমন ছিল তার একটি ছবি প্রথমবারের মতো তুলতে পেরেছে যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা’র জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ বা জেডব্লিউএসটি। ছায়াপথের এই ছবি ক্রিসমাসের মতোই অনুভূতি দিয়েছে মহাকাশ বিজ্ঞানীদের।
স্কটল্যান্ডের জ্যোতির্বিজ্ঞানী অধ্যাপক ক্যাথরিন হেইম্যানস বিবিসিকে বলেছেন, “আমি এই ঝলমলে ছায়াপথকে ভালোবাসি, যেখানে ক্রিসমাসের মতো আলো জ্বলজ্বল করছে। মহাবিশ্বের বয়স যখন ৬০ কোটি বছর ছিল ঠিক ওই সময়ের মতো।”
জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের ছবিতে দেখা যাচ্ছে, নানা রঙের তারার দশটি বল। যা মহাবিশ্বে ঝুলছে ক্রিসমাস ট্রি’র বাবলের মতো।
এই প্রথম আমাদের মিল্কিওয়ে ছায়াপথের মতো কোনো ছায়াপথ তৈরি হতে দেখেছেন বিজ্ঞানীরা, যা মহাবিশ্ব কীভাবে গঠিত হয়েছিল এর সূত্র দিয়েছে।
দূরবর্তী এই ছায়াপথটিকে ‘ফায়ারফ্লাই স্পার্কল’ নামে বর্ণনা করেছেন বিজ্ঞানীরা। কারণ, এটি দেখতে অনেকটা নানা রঙের জোনাকির ঝাঁকের মতো বলে দাবি তাদের।
“মহাবিশ্ব গঠনের প্রাথমিক পর্যায়ে কী ঘটেছিল তার তথ্য পাওয়ার বিষয়টি খুবই বিরল,” বলেছেন এ গবেষণার সহ-প্রধান গবেষক ও ম্যাসাচুসেটসের ‘ওয়েলেসলি কলেজ’-এর অধ্যাপক ড. লামিয়া মাওলা।
“জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের ছবিতে আমরা আসলে এমন একটি ছায়াপথ দেখতে পেয়েছি যেটি ধীরে ধীরে তৈরি হচ্ছে। সাধারণত আশপাশে যেসব ছায়াপথ আমরা দেখি তা এরইমধ্যে গঠিত হয়েছে। ফলে, এই প্রথম আমরা এই প্রক্রিয়াটি দেখতে পেলাম।”
গবেষণা দলের এই আবিষ্কারকে ‘বিস্ময়কর, বৈজ্ঞানিক দিকথেকে গুরুত্বপূর্ণ ও অসম্ভব ঘটনাবহুল’ বলে বর্ণনা করেছেন স্কটল্যান্ডের জ্যোতির্বিজ্ঞানী প্রফেসর হেইম্যানস।
“আমি মনে করি, এমন এক বিস্ময়কর টেলিস্কোপ মানুষ তৈরি করেছে, যা আমাদের বর্তমান সময়ের অনেক পেছনে গিয়েও দেখতে পারে। এর ফলে আমরা ছায়াপথের খুব নবজাতক বিভিন্ন পর্যায়ও এতো সুন্দরভাবে দেখতে পারছি।”
ড. মাওলা বলেছেন, এসব তারা গুচ্ছ বিভিন্ন রঙের হওয়ার কারণ হচ্ছে, তারা’র গঠনের বিভিন্ন পর্যায় থাকে।
“এগুলো এত সুন্দর কারণ ছায়াপথ নিজের প্রাথমিক জীবনে অনেক বেশি সক্রিয় থাকে।”
“মহাবিশ্বে অনেক কিছু ঘটছে, নতুন তারার জন্ম হচ্ছে, বিশাল আকারের তারা মারা যাচ্ছে। ছায়াপথের আশপাশে প্রচুর গ্যাস ও ধূলিকণা রয়েছে। একইসঙ্গে নাইট্রোজেন ও অক্সিজেন রয়েছে। ফলে তারা যে অবস্থায় রয়েছে এর কারণেই আমরা এতো সুন্দর বিভিন্ন রং দেখতে পাচ্ছি।”
“প্রতিটি তারা গুচ্ছের বয়স, এদের বিভিন্ন উপাদানের গঠন ও যে তাপমাত্রায় তারা গঠিত হয়েছে সে সম্পর্কে আমরা এখন অনেক কিছুই জানি।”
জেমস ওয়েস টেলিস্কোপ এক হাজার তিনশ কোটি আলোকবর্ষেরও বেশি দূরের ছবি তুলতে সক্ষম হয়েছে বলে প্রতিবেদনে লিখেছে বিবিসি।
‘ফায়ারফ্লাই স্পার্কল’ ছায়াপথ থেকে আসা আলো মহাবিশ্ব তৈরির খুব বেশি দিন পরের কথা নয়। তাই আমাদের কাছে পৌঁছাতে এক হাজার তিনশ কোটি বছরেরও বেশি সময় লেগেছে এটির। ছায়াপথটি এত ছোট ও এত দূরে যে জেমস ওয়েস টেলিস্কোপও এটি দেখতে পেত না, যদি না এটি এক মহাজাগতিক কাকতালীয় ঘটনা না হত।
ফায়ারফ্লাই স্পার্কল ও জেডব্লিউএসটি’র ঠিক মাঝখানে ছায়াপথের একটি গুচ্ছ ছিল। যা দূরবর্তী ছায়াপথ থেকে আলোকে প্রসারিত করতে স্থানকালকে বিকৃত করেছে এবং কার্যকরভাবে একটি বিশাল ম্যাগনিফাইং গ্লাস হিসাবেও কাজ করেছে টেলিস্কোপটি।
এ প্রক্রিয়াটিকে ‘গ্র্যাভিটেশনাল লেন্সিং’ বলে বর্ণনা করেছেন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা, যেখানে প্রথমবারের মতো বিভিন্ন ছায়াপথ কীভাবে গঠিত হয়েছিল এর বিস্ময়কর তথ্য পেয়েছেন এ গবেষণার সহ-প্রধান গবেষক ও নিউ ইয়র্কের ‘কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটি’র অধ্যাপক ড. কার্তিক আইয়ার এবং দলের অন্যান্য সদস্যরা।
গবেষণাটি প্রকাশ পেয়েছে বিজ্ঞানভিত্তিক জার্নাল ‘নেচার’-এ।