
মানব ইতিহাসে নির্মিত সবচেয়ে বড় রকেট ‘স্টারশিপ’-এর নবম পরীক্ষামূলক উৎক্ষেপণ মহাকাশে পৌঁছাতে সক্ষম হলেও, শেষ পর্যন্ত এটি পৃথিবীতে ফেরার পথে আকাশেই বিস্ফোরিত হয়েছে। এই ঘটনাকে মার্কিন দৈনিক নিউ ইয়র্ক টাইমস ‘এখন পর্যন্ত চালানো সবচেয়ে দীর্ঘ ও উন্নত পরীক্ষামূলক উৎক্ষেপণ’ বলে বর্ণনা করেছে।
মহাকাশ যাত্রা ও অনাকাঙ্ক্ষিত বিস্ফোরণ
মঙ্গলবার সন্ধ্যায় যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসের স্টারবেইস থেকে বাংলাদেশ সময় ভোর ৬টা ৩৭ মিনিটে রকেটটি উৎক্ষেপণ করা হয়। স্পেসএক্সের ওয়েবসাইটে এই উৎক্ষেপণের সরাসরি সম্প্রচার দেখা গেছে। মহাকাশের দিকে ছুটে যাওয়ার সময়ই রকেটের প্রপেলান্টে লিক ধরা পড়ে, যার ফলে এটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পাক খেতে শুরু করে। এই সময় এর যাত্রীবাহী অংশ ‘স্টারশিপ’ অক্ষত থাকলেও, পৃথিবীতে বায়ুমণ্ডলে প্রবেশের সময় তীব্র তাপে সেটি ধ্বংস হয়ে যায়। রকেটের ধ্বংসাবশেষ জনবসতিপূর্ণ এলাকা থেকে অনেক দূরে ভারত মহাসাগরে পড়েছে।
এলন মাস্কের স্বপ্নের পথে বাধা ও অগ্রগতি
নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইলন মাস্কের মঙ্গল যাত্রার স্বপ্ন সফল করতে হলে স্টারশিপে, বিশেষ করে এর শীর্ষ অংশে এখনও অনেক কাজ বাকি। এবারের ফ্লাইটটি বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষার জন্য নির্ধারিত ছিল, যার মধ্যে নতুন প্রজন্মের স্টারলিংক স্যাটেলাইটের সিমুলেটর কক্ষপথে স্থাপন এবং রকেটের হিট শিল্ড কতটা উন্নত করা সম্ভব হয়েছে তার মূল্যায়ন অন্তর্ভুক্ত ছিল। তবে, রকেটের পেলোড ডোর না খোলায় এই পরীক্ষাগুলো সম্পন্ন করা সম্ভব হয়নি।
কিছু সাফল্য, কিছু অসম্পূর্ণতা
এসবের পরেও বুধবারের এই প্রচেষ্টায় বেশ কিছু সাফল্যও যোগ হয়েছে। সবচেয়ে বড় সফলতা হলো, আগের দুবারের মতো এবার রকেট যাওয়ার পথে বিস্ফোরিত হয়নি। আরেকটি বড় সাফল্য হচ্ছে এবারের বুস্টার আগেও ব্যবহৃত হয়েছিল, যা স্পেসএক্স একটি বড় উন্নয়ন হিসাবে দেখছে। তবে এই সাফল্যও অসম্পূর্ণ, কারণ পুনঃব্যবহৃত বুস্টারটি উৎক্ষেপণের সময় কাজ করলেও, ফেরার পথে তিনটি ইঞ্জিন ব্যবহার করে অবতরণের অনুকরণ করতে গিয়ে এটি নিয়ন্ত্রণ হারায় এবং উপসাগরীয় এলাকায় ভেঙে পড়ে।
স্পেসএক্স জানিয়েছে, তিন ইঞ্জিনের বিষয়টি পরীক্ষারই একটি অংশ ছিল এবং কোম্পানিটি বুস্টারের সক্ষমতা বাড়ানোর লক্ষ্যে বিভিন্ন পরীক্ষা চালাচ্ছিল।
পূর্ববর্তী ব্যর্থতা ও ভবিষ্যতের পথ
এর আগের দুটি উৎক্ষেপণ চেষ্টায় উপরের স্তরের রকেটগুলি আকাশেই বিস্ফোরিত হয়েছিল। সপ্তম ফ্লাইটে অতিরিক্ত কম্পনের কারণে প্রপেলান্ট লিক হয়ে আগুন ধরে যায়, আর অষ্টম ফ্লাইটে ইঞ্জিন নিয়ন্ত্রণ হারায়। তবে, আগের কিছু ফ্লাইট—বিশেষত চতুর্থ, পঞ্চম ও ষষ্ঠ ফ্লাইটে এটি মহাকাশে গিয়ে পৃথিবীতে ফিরে এসে সিমুলেটেড ল্যান্ডিংয়ে সফল হয়েছিল।
এ যাবৎকালের সবচেয়ে শক্তিশালী রকেট স্টারশিপের দুটি অংশ রয়েছে: একটি ‘সুপার হেভি বুস্টার’ নামের তরল গ্যাসের জ্বালানিচালিত রকেট এবং অপর অংশটি হলো ‘স্টারশিপ’ নামের মহাকাশযান, যা এই ‘সুপার হেভি বুস্টারের’ ওপর বসানো থাকে। এতে ৩৩টি ইঞ্জিন রয়েছে, যা মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার আর্টেমিস রকেটের দ্বিগুণেরও বেশি শক্তিশালী।
সর্বশেষ স্টারশিপ পরীক্ষা হয়েছিল গত মার্চ মাসে, যেখানে ১২৩ মিটার দীর্ঘ রকেটটি উৎক্ষেপণের ১০ মিনিট পরই বিস্ফোরিত হয়। এর ফলে ফ্লোরিডা ও ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের আকাশপথে উড়োজাহাজ চলাচলে বিঘ্ন ঘটেছিল। ওই সময় প্লেনের ফ্লাইট বন্ধের জন্য “মহাকাশের ধ্বংসাবশেষ পড়ে যাওয়ার”কে দায়ী করেছিল যুক্তরাষ্ট্রের ‘ফেডারেল এভিয়েশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন’ (FAA)। এ ঘটনার পর নিরাপত্তা নিয়ে তদন্তও শুরু করেছিল সংস্থাটি। গত সপ্তাহে এ নিয়ে তদন্ত শেষ করে নিয়ন্ত্রক সংস্থা স্পেসএক্সকে উন্নত সংস্করণের স্টারশিপ উৎক্ষেপণেরও অনুমতি দিয়েছে।
নতুন স্টারশিপ রকেটটিতে বেশ কিছু পরিবর্তন এনেছিল স্পেসএক্স, যাতে এটি আরও নির্ভরযোগ্য হয়ে ওঠে এবং এতে আর কোনো বড় ধরনের দুর্ঘটনা না ঘটে। সর্বশেষ এই উৎক্ষেপণ প্রচেষ্টার আগে এক ব্লগ পোস্টে স্পেসএক্স লিখেছিল, “আমরা যত বেশিবার রকেটটিকে উৎক্ষেপণের পরীক্ষা করব, তত দ্রুত শিখতে পারব ও প্রয়োজনমতো এর ডিজাইনে পরিবর্তন আনতে পারবো। এর ফলে স্টারশিপকে সম্পূর্ণ ও দ্রুত পুনঃব্যবহারযোগ্য মহাকাশযান হিসেবে চালু করা সম্ভব হবে। তবে, সংজ্ঞা অনুসারে, যে কোনো পরীক্ষাতে স্বাভাবিকভাবেই অনিশ্চয়তা থাকে।”