ভিন্ন ‘সৌরজগত’ থেকে আসা বস্তুর ওপর নজর বিজ্ঞানীদের, জেনেনিন কেন এই পদক্ষেপ?

জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা সম্প্রতি আরও একটি বিরল ‘ইন্টারস্টেলার অবজেক্ট’ বা আন্তঃনাক্ষত্রিক বস্তুর সন্ধান পেয়েছেন। তাঁদের দাবি, এটি আমাদের সৌরজগতের বাইরের কোনো তারা-ব্যবস্থা থেকে এসে এখন আমাদের সৌরজগতের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এমন ঘটনা অত্যন্ত বিরল; এর আগে বিজ্ঞানীরা মাত্র দুটি এমন বস্তুর সন্ধান পেয়েছিলেন – ‘ওউমুয়ামুয়া’ এবং ‘২আই/বোরিসভ’। এই নতুন আবিষ্কারটি সত্যি হলে, এটি হবে তৃতীয় পরিচিত আন্তঃনাক্ষত্রিক বস্তু, যা মহাকাশের বাইরের রহস্য বোঝার ক্ষেত্রে বিজ্ঞানীদের জন্য এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে।

নতুন আগন্তুকের সন্ধান:
মঙ্গলবার ‘ইউনিভার্সিটি অফ হাওয়াই’-এর ‘অ্যাস্টেরয়েড টেরেস্ট্রিয়াল-ইমপ্যাক্ট লাস্ট অ্যালার্ট সিস্টেম’ (ATLAS)-এর গবেষণা দল এই মহাকাশীয় বস্তুটি খুঁজে পেয়েছে। ব্রিটিশ দৈনিক ইন্ডিপেন্ডেন্টের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বস্তুটি বর্তমানে বৃহস্পতির কাছ দিয়ে চলাচল করছে। তবে এর ধরন বা দেখতে কেমন, সে বিষয়ে এখনও স্পষ্ট কোনো তথ্য জানা যায়নি। বিজ্ঞানীরা এখন নিশ্চিত হতে চাইছেন যে, এটি সত্যিই আন্তঃনাক্ষত্রিক কোনো বস্তু কি না, যার জন্য আরও নিবিড় পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে।

বিশ্বজুড়ে পর্যবেক্ষণ:
ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থা (ESA) বুধবার একটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম পোস্টে জানিয়েছে, “এখন গোটা বিশ্বের টেলিস্কোপ ব্যবহার করে ESA-এর প্ল্যানেটারি ডিফেন্ডার দল এই বস্তুটি পর্যবেক্ষণ করছে, যার অস্থায়ী নাম দেওয়া হয়েছে #এ১১পিএলথ্রিজেড।” এদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা-ও পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে বলে জানিয়েছে।

‘ইউনিভার্সিটি অফ অ্যারিজোনা’র ‘ক্যাটালিনা স্কাই সার্ভে’-এর গবেষক ডেভিড র‍্যাঙ্কিন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্লুস্কাই’তে জানিয়েছেন, বস্তুটি খুঁজে পাওয়ার পর থেকেই এর ওপর নিবিড় নজর রাখা হচ্ছে। ক্যালেটেকের ‘জুইকি ট্রানশিয়েন্ট ফ্যাসিলিটি’-এর আর্কাইভাল ইমেজেও (পুরনো ছবি) এই বস্তুটি আগে দেখা গিয়েছিল বলে প্রমাণ মিলেছে, যা ইঙ্গিত দেয় যে এটি সত্যিই আমাদের সৌরজগতের বাইরের বা আন্তঃনাক্ষত্রিক উৎস থেকে এসেছে।

র‍্যাঙ্কিন ব্লুস্কাই’তে আরও লিখেছেন, “কয়েকটি প্রিকভারি পর্যবেক্ষণ ও পরবর্তী অনুসন্ধানের পর স্পষ্ট হয়েছে, এই বস্তুটি সৌরজগতের মধ্য দিয়ে একটি হাইপারবোলিক পথ ধরে চলছে।” ইন্ডিপেন্ডেন্টের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এরপর থেকে নতুন নতুন পর্যবেক্ষণ ‘আসতে শুরু করেছে’, যা জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের বস্তুটির কক্ষপথ আরও ভালোভাবে নির্ধারণ করতে সাহায্য করছে।

পূর্ববর্তী আন্তঃনাক্ষত্রিক বস্তু:
আমাদের সৌরজগতে ‘ঘুরতে আসা’ প্রথম পরিচিত আন্তঃনাক্ষত্রিক বস্তু ছিল ‘ওউমুয়ামুয়া’, যেটি ২০১৭ সালে দেখা গিয়েছিল। এটি প্রায় সিকি মাইল দীর্ঘ ও এক দশমাংশ প্রস্থের এক লালচে পাথুরে সিগারের মতো দেখতে ছিল। এর দৈর্ঘ্য-প্রস্থের এমন অনুপাত আগে আমাদের সৌরজগতের কোনো গ্রহাণু বা ধূমকেতুর মধ্যে দেখা যায়নি, যে কারণে অনেকে ধারণা করেছিলেন, বস্তুটি হয়তো কোনো ভিনগ্রহের মহাকাশযান হতে পারে। ওই সময় নাসার পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছিল, এটি আমাদের তারামণ্ডলে প্রবেশের বহু আগেই কোটি কোটি বছর ধরে মিল্কি ওয়ের মধ্যে ঘুরে বেড়িয়েছে।

দ্বিতীয় পরিচিত আন্তঃনাক্ষত্রিক বস্তুটি ছিল ধূমকেতু ‘২আই/বোরিসভ’, যার খোঁজ মেলে ২০১৯ সালে। এটিই ছিল প্রথমবারের মতো নিশ্চিতভাবে শনাক্ত করা আন্তঃনাক্ষত্রিক ধূমকেতু, যা পরে নাসার হাবল স্পেস টেলিস্কোপও পর্যবেক্ষণ করেছে।

ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা:
বিজ্ঞানীদের অনুমান, এ ধরনের আরও অনেক বস্তু নিয়মিতভাবেই পৃথিবীর কাছ দিয়ে এবং প্রতি বছর এদের মধ্যে কয়েকটি আমাদের পৃথিবীর বেশ কাছে দিয়ে উড়ে যায়। তবে এই বস্তুগুলো সহজে দেখা না যাওয়ায় এবং ঠিক কোথা থেকে এসেছে তা নিশ্চিতভাবে জানা অসম্ভব হওয়ায় চিহ্নিত করা বেশ কঠিন। গবেষকরা বলছেন, ভবিষ্যতে এসব বস্তু নিয়ে আরও অনেক কিছু জানা যাবে এবং এগুলোকে দূরবর্তী তারামণ্ডলী ও গ্রহগুলোর প্রমাণ হিসেবেও ব্যবহার করা যেতে পারে।

সম্প্রতি চালু হওয়া ‘ভেরা সি রুবিন মানমন্দিরে’র মতো নতুন এবং আরও শক্তিশালী টেলিস্কোপের মাধ্যমে ভবিষ্যতে অনেক আন্তঃনাক্ষত্রিক বস্তু খুঁজে পাওয়া যাবে বলে বিজ্ঞানীরা আশা করছেন, যা মহাকাশের বিশালতা এবং এর অজানা রহস্য উন্মোচনে সাহায্য করবে।

Related Posts

© 2025 News - WordPress Theme by WPEnjoy