বিশেষ: মহাকাশে তারার বিস্ফোরণও কি পৃথিবীর জলবায়ুতে প্রভাব ফেলে? কী বলছে গবেষকরা?

বিশালাকার নক্ষত্রের ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণ, যা সুপারনোভা নামে পরিচিত—মহাকাশে শক্তিশালী কণার ঢেউ ছড়িয়ে দেয়। এই শক্তিশালী কণাগুলো হাজার হাজার আলোকবর্ষ পাড়ি দিয়ে বিভিন্ন মহাজাগতিক বস্তু ভেদ করে পৃথিবীতেও পৌঁছাতে পারে। সম্প্রতি প্রকাশিত এক নতুন গবেষণায় চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে: অতীতে পৃথিবীতে আকস্মিক জলবায়ু পরিবর্তনের কারণ ছিল এসব মহাজাগতিক বিস্ফোরণ, বিশেষ করে সুপারনোভা। শুধু তাই নয়, ভবিষ্যতেও এমনটি আবারও ঘটতে পারে!

‘মান্থলি নোটিসেস অফ দ্য রয়্যাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটি’ নামক বিজ্ঞানভিত্তিক জার্নালে প্রকাশিত এই গবেষণাপত্রে ‘ইনস্টিটিউট অফ আর্কটিক অ্যান্ড অ্যালপাইন রিসার্চ’-এর জ্যেষ্ঠ গবেষক রবার্ট ব্রাকেনরিজ দাবি করেছেন, অতীতে পৃথিবীর আবহাওয়ার বড় পরিবর্তনের পেছনে তারার বিশাল বিস্ফোরণ বা সুপারনোভা মূল কারণ হতে পারে।

বিজ্ঞানীরা দীর্ঘকাল ধরে পৃথিবীর ইতিহাসে ঘটে যাওয়া অনেক আকস্মিক পরিবেশগত পরিবর্তনের বিষয়ে অবগত। তবে সবসময় সবচেয়ে বড় প্রশ্ন ছিল, এসব পরিবর্তনের নেপথ্যে আসল কারণ কী? পরিবেশের পরিবর্তন নতুন কিছু না হলেও, ঠিক কী কারণে এই বদলগুলো ঘটত, সেটা আজও রহস্য ছিল। ব্রাকেনরিজের অনুমান, এই প্রশ্নের উত্তর হয়তো তারার ভেতরেই লুকিয়ে রয়েছে। বিশেষ করে, আমাদের সৌরজগতের আশপাশের বিভিন্ন সুপারনোভাগুলো এতটাই শক্তিশালী হতে পারে যে, তা পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে সক্ষম।

গবেষণায় উঠে এসেছে, সুপারনোভা বিস্ফোরণ থেকে আসা বিকিরণ বা রেডিয়েশন কীভাবে পৃথিবীর ওজোন স্তরের ক্ষয় ঘটাতে পারে এবং মিথেনের মতো গ্রিনহাউস গ্যাসের পরিমাণ পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে কমিয়ে দিতে পারে। এই দুটি বিষয় সম্মিলিতভাবে এমন পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে, যেখানে সূর্যের আরও বেশি ক্ষতিকর আলট্রাভায়োলেট রশ্মি পৃথিবীর পৃষ্ঠে পৌঁছাবে। এর ফলে পৃথিবীর তাপ ধরে রাখার সক্ষমতা কমে যাবে। পরিণতি? পৃথিবী ঠান্ডা হয়ে যাবে, দাবানল বাড়বে এবং এমনকি ব্যাপক বিলুপ্তির ঘটনাও ঘটতে পারে।

ব্রাকেনরিজের এই ধারণা নতুন না হলেও, পূর্বে এটি মূলত তাত্ত্বিক পর্যায়ে ছিল, অর্থাৎ পদার্থবিজ্ঞান ও মহাকাশ মডেলের ওপর ভিত্তি করে তৈরি ছিল যার বাস্তব প্রমাণ ছিল কম। তবে এখন উন্নত মহাকাশ দূরবীক্ষণ যন্ত্র এবং সুপারনোভার বিকিরণ কীভাবে কাজ করে তা আরও ভালোভাবে বোঝার কারণে গবেষক ব্রাকেনরিজ আরও সঠিক মডেল তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন।

যেহেতু বর্তমানে সুপারনোভা বিকিরণের প্রভাব পৃথিবীতে সরাসরি পড়ছে না, তাই ব্রেকেনরিজ তার গবেষণার সূত্রের জন্য ইতিহাসের দিকে ঝুঁকেছেন। তিনি এর জন্য ‘ট্রি রিংস’ বা গাছের বলয় নিয়ে পরীক্ষা করেছেন। গাছ যত বড় হয়, ততই তারা বাতাস থেকে কার্বন ধরে রাখে তাদের গুঁড়িতে। গাছের এই বলয়গুলোতে পৃথিবীর অতীতের পরিবেশগত তথ্য লুকিয়ে থাকতে পারে, যা থেকে বিজ্ঞানীরা জলবায়ুর ইতিহাস বুঝতে পারেন।

গবেষকরা বলছেন, পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে সুপারনোভা প্রভাব ফেলার কারণে গাছ যে ধরনের কার্বন শোষণ করে, তা বদলে যেতে পারে। গাছের বলয় বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন সময়ে বায়ুমণ্ডলের অবস্থা কেমন ছিল তা জানতে পারেন। ১৫ হাজার বছরের গাছের বলয় তথ্য বিশ্লেষণ করে ব্রাকেনরিজ হঠাৎ করে বেড়ে যাওয়া ১১টি রেডিওঅ্যাকটিভ কার্বনের পরিমাণ খুঁজে পেয়েছেন। তার অনুমান, এগুলো হয়তো জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের জানা ১১টি সুপারনোভার সঙ্গে মিলে যেতে পারে, যা প্রায় একই সময়ে ঘটেছিল।

গবেষকরা বলছেন, এই ঘটনাগুলোর সময় ও তীব্রতা একসঙ্গে মেলে, যা থেকে জোরালো ইঙ্গিত মিলেছে যে, বিভিন্ন মহাজাগতিক বিস্ফোরণ এবং পৃথিবীর জলবায়ু পরিবর্তনের মধ্যে সম্ভাব্য সম্পর্ক থাকতে পারে।

গবেষকরা মনে করছেন, সুপারনোভাই একমাত্র কারণ নয়; সূর্যের সৌর শিখাও একই রকম প্রভাব ফেলতে পারে। তবে ব্রাকেনরিজের অনুমান, সুপারনোভার যুক্তি আরও শক্তিশালী হচ্ছে। তিনি বরফের কোর বা সমুদ্রের তলদেশের পলিমাটি নিয়ে গবেষণা করে এ সম্পর্কে আরও প্রমাণ পাওয়ার আশাবাদী।

এই সম্পর্ক বোঝা কেবল অতীতের রহস্য উন্মোচনের জন্যই নয়, বরং ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুতি নিতেও সাহায্য করতে পারে বলে দাবি গবেষকদের। ব্রাকেনরিজ সতর্ক করে বলেছেন, আগামী ১ লাখ বছরের মধ্যে যেকোনো সময়ে, এমনকি আগামীকালও, পৃথিবীর নিকটবর্তী ‘বেটেলগাইজ’ নামের এক তারা সুপারনোভা হিসেবে বিস্ফোরিত হতে পারে। তিনি বলেন, “এ ধরনের ঘটনা যদি পৃথিবীর দিকে বিকিরণ পাঠায়, তাহলে তা আমাদের জলবায়ু ও পরিবেশে বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে।” এই গবেষণা আমাদের মহাজাগতিক পরিবেশের সঙ্গে পৃথিবীর জটিল সম্পর্ককে নতুন করে বুঝতে সাহায্য করছে।

Related Posts

© 2025 Tech Informetix - WordPress Theme by WPEnjoy