ইলন মাস্ক, বিল গেটস, মার্ক জাকারবার্গসহ নানা নাম আমরা অহরহই শুনতে পাই যারা প্রথাগত লেখাপড়া শেষ করেননি কিন্তু নিজেদের উদ্ভাবনের কারণেই নাম লিখিয়েছেন শ্রেষ্ঠতম ধনীদের তালিকায়। সব উদ্ভাবকের ভাগ্যই কি এমন?
এমনও বিজ্ঞানী আছেন যাদের কারণে বদলে গেছে দৈনন্দিন জীবন, সমাজ এমনকি রাষ্ট্রও। অথচ তাদের ভাগ্যে হয়নি কোনো উনিশবিশ।
এমনই ১০ জন উদ্ভাবকের কথা রয়েছে আজকের প্রতিবেদনে।
জন ওয়াকার
দিয়াশলাই এখন হাতে হাতে ঘোরে। আর এই বিপ্লব শুরু হয়েছিল উনিশ শতকের শুরুতে। ১৮২৬ সালে ইংল্যান্ডে প্রথম ঘষা দিয়ে জ্বালানো ম্যাচ উদ্ভাবন করেন ব্রিটিশ রসায়নবিদ জন ওয়াকার। এমনকি পরের বছর থেকে স্যান্ডপেপার স্ট্রাইক প্যাড’সহ বাক্সে প্যাকেজওয়ালা কার্ডবোর্ড ম্যাচ বিক্রিও শুরু করেন তিনি। এর মাধ্যমে শিগগিরই ওয়াকারের উদ্ভাবনের খবর ছড়িয়ে পড়ে দিকে দিকে। বিদ্যুতের জনক হিসেবে পরিচিত মাইকেল ফ্যারাডে’সহ সেই সময়ের অনেক উদ্ভাবকের পরামর্শ উপেক্ষা করে ওয়াকার দৃঢ়ভাবে নিজের এই উদ্ভাবনটির পেটেন্ট করতে অস্বীকার করেন।
তবে ওয়াকারের উদ্ভাবিত এই ঘর্ষণ ম্যাচের নকল বা কপি তখন কমবেশি সবাই করেন। বলাই বাহুল্য, নিজের বিস্ময়কর এই উদ্ভাবন থেকে খুব কমই অর্থ আয় করেছেন ওয়াকার।
লাসজলো বিরো
১৯৩৮ সালে প্রথম বাণিজ্যিকভাবে কার্যকর বলপয়েন্ট কলম তৈরি করেন হাঙ্গেরিয়ান-আর্জেন্টাইন উদ্ভাবক লাসজলো বিরো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসি অধিকৃত হাঙ্গেরি থেকে পালিয়ে আর্জেন্টিনায় যান তিনি, যেখানে নিজের উদ্ভাবনকে করেন আরও নিখুঁত।
তবে বলপয়েন্ট কলমের উপর নিজের সব ধরনের স্বত্ত্বাধিকার ছেড়ে ১৯৪৫ সালে মার্সেল বিচের কাছে পেটেন্টটি বিক্রি করে দেন বিরো। এর পর মার্সেল বিচের ‘বিচ বিক’ কোম্পানিটি বিস্ময়করভাবে ১০ হাজার কোটি ডলার আয় করে এসব কলম বিক্রির মাধ্যমে।
নিক হলোনিয়াক জুনিয়র
১৯৬২ সালে লেজার তৈরির চেষ্টা করেন ইলেকট্রিক বিজ্ঞানী নিক হলোনিয়াক জুনিয়র। এ সময় প্রথম ব্যবহারিক এলইডি লাইট তৈরি করেন তিনি। ওই সময় হলোনিয়াক বলেছিলেন, একদিন টমাস আলভা এডিসনের আলোর বাল্বকেও ছাড়িয়ে যাবে তার এ উদ্ভাবন। হলোনিয়াক ভুল বলেননি।
বর্তমানে সবখানেই ব্যবহার হচ্ছে এলইডি লাইটের। তবে দুঃখজনকভাবে তার এ উদ্ভাবনের জন্য কোনও অর্থ পাননি হলোনিয়াক। এমনকি উদ্ভাবনের জন্য নোবেল পুরষ্কারও মেলেনি তার ভাগ্যে।
রন ক্লেইন
অর্থ সংশ্লিষ্ট অনেক আবিষ্কার রয়েছে ‘সম্ভাবনার দাদু’ বলে পরিচিত আমেরিকান উদ্ভাবক রন ক্লেইনের ঝোলায়। তার সবচেয়ে বিখ্যাত আবিষ্কার হচ্ছে, ১৯৬০ এর দশকে তৈরি চৌম্বকীয় ক্রেডিট কার্ড। তবে, এর থেকে কোনও অর্থ আয় করেননি ক্লেইন। ১৯৯০ সালে ‘আলট্রোনিক সিস্টেমস কর্পোরেশন’ নামে ক্লেইনের একটি কোম্পানি’কে কেবল তার আবিষ্কারের জন্য দেওয়া হয়েছে পেটেন্ট বা বিশেষ এক আইনি অধিকার।
শিগগিরই বিভিন্ন প্রতিদ্বন্দ্বী কোম্পানি আইন ভেঙে ক্লেইনের উদ্ভাবিত প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু করে ও তা গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে দেয়। আর ‘আলট্রনিক’ কোম্পানিটি নিজের আইনি সুবিধা প্রয়োগ না করায় ওই উদ্ভাবন থেকে কোনও অর্থ আয় করেননি ক্লেইন।
ডগলাস এঙ্গেলবার্ট
পেটেন্ট করার মাধ্যমে নিজের উদ্ভাবনের ওপর নির্দিষ্ট সময়ের জন্য অধিকার আরোপ করা যায় বটে। তবে, সে সময়টি পেরিয়ে গেলে আর ‘নকল’ ঠেকানোর উপায় থাকে না। ঠিক এ ঘটনাটিই ঘটেছে কম্পিউটার মাউসের বেলায়।
১৯৬৭ সালে প্রথম মাউস তৈরির জন্য একটি পেটেন্ট অর্জন করেছিলেন কম্পিউটারের অগ্রদূত কিউ ডগলাস এঙ্গেলবার্ট। আর ৮০’র দশকের শেষের দিকে এ প্রযুক্তিটি যখন বাণিজ্যিকভাবে সাফল্য পাওয়ার দ্বারে, তখনি শেষ হয়ে যায় এঙ্গেলবার্টের পেটেন্টের মেয়াদ। ফলে, বিশ্বের শত কোটি মানুষের হাতে যে প্রযুক্তি, তা থেকে কোনও অর্থ পাননি তিনি।
ডাইসুকে ইনোই
১৯৬০ এর দশকের শেষের দিকে বিনোদনের একটি ফর্ম ‘কারাওকে’ অর্থাৎ খালি বা ভয়েস ছাড়া অর্কেস্ট্রার ধারণা নিয়ে আসেন জাপানের উদ্ভাবক ডায়াসুকে ইনোই। ১৯৭১ সালে প্রথম অস্থায়ী কারাওকে টেপ ও মাইক্রোফোন মেশিন তৈরি করেন তিনি। তবে, এ উদ্ভাবনের জন্য কোনও পেটেন্ট আবেদন করেননি ইনোই। আর, স্বাভাবিকভাবেই এ থেকে সরাসরি কোনো অর্থও আয় হয়নি তার।
অর্থ না পেলেও জাপানি এই উদ্ভাবক ২০০৫ সালে নোবেল পুরস্কার জেতেন এবং টাইম ম্যাগাজিন তাকে বর্ণনা করেছে বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রভাবশালী এশীয় হিসাবেও।
ট্রেভর বেইলিস
১৯৯০ এর দশকের গোড়ার দিকে প্রথম ‘উইন্ড আপ’ রেডিও তৈরি করেন ব্রিটিশ উদ্ভাবক ট্রেভর বেইলিস। উইন্ড আপ রেডিও সাধারণ রেডিওম মতোই, কেবল এতে ব্যাটারির বদলে থাকে সেলাই মেশিনের হাতলের মত একটি হাতল, যেটি ঘুরিয়ে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করা যায়, আর তাতেই চলে রেডিওটি।
আফ্রিকায় এইচআইভি বিস্তার নিয়ে একটি টিভি প্রতিবেদন থেকে এই রেডিও তৈরির অনুপ্রেরণা পান বেইলিস। লন্ডনে জন্মগ্রহণকারী এই উদ্ভাবক ১৯৯২ সালে তার উদ্ভাবনের জন্য প্রথম পেটেন্ট লাভ করেন।
তবে গ্যাজেট বিক্রির চেয়ে রেডিওর প্রচারণা থেকে বেশি অর্থ আয় করেন তিনি। বেইলিস বলেছেন, তার এই ডিভাইসটি ‘নকল’ করেছে বড় বড় বিভিন্ন কোম্পানি, যার ফলে কমে গিয়েছে তার নিজের তৈরি ডিভাইসটির দাম।
শেন চেন, টিম বার্নার্স-লি, ট্রেভর বেইলিস, আলেক্সেই পাজিতনভ
শেন চেন, টিম বার্নার্স-লি, ট্রেভর বেইলিস, আলেক্সেই পাজিতনভ
আলেক্সেই পাজিতনভ
১৯৮৪ সালে সফলভাবে ‘টেট্রিস’ কম্পিউটার গেইম তৈরি করেন প্রোগ্রামার আলেক্সেই পাজিতনভ। তিনি ছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়নের বিজ্ঞান একাডেমির একজন কর্মী। যার ফলে, এ উদ্ভাবন থেকে ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হওয়ার সুযোগ মেলেনি পাজিনভের।
তার কমিউনিস্ট মতাদর্শের প্রেক্ষিতে, সোভিয়েত সরকার জনপ্রিয় এ গেইমটির স্তত্ত্বাধিকার ধরে রাখে। ১৯৯০ এর দশকে সোভিয়েত সরকারের পতন না হওয়া পর্যন্ত এই গেইমের মেধাস্বত্ত্ব পাননি পাজিতনভ।
টিম বার্নার্স-লি
ইন্টারনেটের স্রষ্টা হিসেবে পরিচিত টিম বার্নার্স-লি ১৯৮৯ সালে ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব তৈরিতে ব্যবহৃত মূল কোডটিকে ‘এনএফটি বা ননফাঞ্জিবল টোকেন’ হিসাবে বিক্রি করেন। ‘এনএফটি’ চারটি অংশ নিয়ে গঠিত, যার মধ্যে রয়েছে সোর্স কোডের ‘অরিজিনাল টাইম-স্ট্যাম্পড ফাইল’, কোডের একটি ‘অ্যানিমেটেড ভিজ্যুয়ালাইজেশন’, বার্নার্স-লি’র মাধ্যমে তৈরি কোডের একটি ‘ডিজিটাল পোস্টার’ এবং তার লেখা একটি চিঠি।
২০২১ সালের ৩০ জুন নিলামে কোডটি বিক্রির সিদ্ধান্ত অবাক করে দেয় বিশ্বকে। তবে বার্নার্স-লি ও তার স্ত্রী রোজমেরি লেইথ বলেছেন, এই বিক্রির অর্থ ভাল কাজে দান করবেন তারা।
শেন চেনে’র হোভারবোর্ড
২০১০ এর দশকের গোড়ার দিকে প্রথম হোভারবোর্ড তৈরি করেন মার্কিন উদ্ভাবক শেন চেন। এজন্য ২০১৪ সালে পেটেন্ট পান তিনি। পেটেন্ট থাকা সত্ত্বেও চেনের এ উদ্ভাবনের নকল বা কপি বের করতে শুরু করে বিভিন্ন চীনা কোম্পানি। সেই ধারাবাহিকতায় ২০১৫ সালের শেষের দিকে ফ্লপ হয় চেনের মূল সংস্করণের হোভারবোর্ডটি।