
তাইওয়ান দ্বীপটিকে চীন মনে করে নিজের ভূখণ্ডের অংশ। যা পুনরায় মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হবে।এর জন্য যদি বলপ্রয়োগের প্রয়োজন হয় তবে তাও করতে পিছপা হবে না বেইজিং। এর মধ্যে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
তবে তাইওয়ানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খাত কিন্তু বিধিনিষেধের বাইরে রয়ে গেছে। সেটি হলো— সেমিকন্ডাক্টর। এর কারণও আছে। চীন তাইওয়ানের এ সেমিকন্ডাক্টরের ওপর নির্ভর করে। আর এর ওপর বিধিনিষেধের অর্থ হলো— নিজের ক্ষতি করা।
সেমিকন্ডাক্টর তাইওয়ানের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ
সেমিকন্ডাক্টরের বিশ্ব বাজারে আধিপত্য বিস্তার করে তাইওয়ান। স্মার্টফোন থেকে শুরু করে মেডিকেল ডিভাইস, কার এবং ফাইটার জেট সবকিছুতেই এ গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ব্যবহৃত হয়।
ট্রেন্ডফোর্সের তথ্য অনুযায়ী, স্বশাসিত এ দ্বীপের সেমিকন্ডাক্টর বাজারের ৬৪ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে। এর মধ্যে অর্ধেকের বেশি অবদান তাইওয়ান সেমিকন্ডাক্টর ম্যানুফেকচারিং কোং (টিএসএমসি) এর।
এর পর বৃহৎ উৎপাদনকারী দক্ষিণ কোরিয়া। বাজারে যার অবদান এক পঞ্চমাংশেরও কম।
বোস্টন কনসাল্টিং এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, উন্নত সেমিকন্ডাক্টরের প্রায় ৯২ শতাংশই তাইওয়ান উৎপাদন করে।
বিশ্বজুড়ে ব্যাপক চাহিদার পর সেমিকন্ডাক্টার দ্বীপটির রপ্তানির প্রায় ৪০ শতাংশের কাছাকাছি এবং জিডিপির ১৫ শতাংশের মতো।
তাইওয়ানের অ্যাকাডিমিয়া সিনিকার অ্যাসিস্ট্যান্ট রিসার্চ ফেলো জেমস লি বলেন, তাইওয়ানের সেমিকন্ডাক্টর শিল্প দ্বীপটির অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। যা দ্বীপটিকে হাই-টেক খাতে নেতৃত্বে নিয়ে এসেছে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লব নির্ভর করবে এ সেমিকন্ডাক্টরের ওপর, যা তাইওয়ানের কোম্পানিগুলো নকশা ও উৎপাদন করতে পারে। সেমিকন্ডাক্টর শিল্প তাইওয়ানের নিরাপত্তার জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এটি যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিম ইউরোপের কাছে তাইওয়ানের কৌশলগত গুরুত্ব বাড়িয়ে তোলে।
যদিও বেইজিং সাইট্রাস ফল ও মাছ আমদানি বন্ধ করেছে, যা তাইওয়ানের অর্থনীতির ওপর সামান্যই প্রভাব ফেলবে। তবে, চীন চিপ আমদানি বন্ধ করলে বড় ক্ষতি হতে পারে দ্বীপটির।
তাইওয়ানের সেমিকন্ডাক্টর কেন প্রয়োজন চীনের
তাইওয়ান তার সেমিকন্ডাক্টর শিল্পের ওপর যতটা নির্ভর করে, চীনও ততটাই করে।
২০২০ কংগ্রেশনাল রিসার্চ সার্ভিসের রিপোর্টের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ অর্থনীতির দেশ চীনের সেমিকন্ডাক্টরের চাহিদা বৈশ্বিক চাহিদার ৬০ শতাংশ। সে চাহিদার ৯০ শতাংশের বেশি আমদানির মাধ্যমে ও বিদেশি সংস্থা পূরণ করে দেশে উৎপাদনের মাধ্যমে।
এ শিল্পের উন্নয়নে শত কোটি ডলার ঢালার পরও সাংহাইভিত্তিক এসএমআইসির নেতৃত্বে সেমিকন্ডাক্টরের বৈশ্বিক বাজারে চীনের হিস্যা ১০ শতাংশেরও কম।
লি বলেন, এ শিল্পে চীন তাইওয়ানের ওপর নির্ভরশীল। কেননা, চীনের প্রতিষ্ঠানগুলো সেমিকন্ডাক্টর নকশা করতে পারে কিন্তু তা উৎপাদনে তাদের ক্ষমতা অত্যন্ত সীমিত। সম্প্রতি জানা গেছে, এসএমআইসি ৭-এনএম চিপ উৎপাদনের সক্ষমতা অর্জন করেছে। যদিও এটি খুবই প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে এবং টিএসএমসি ও স্যামসাং থেকে তারা বেশ পিছিয়ে।
বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশের বিরুদ্ধে বিধিনিষেধ আরোপ করলেও নিজের প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো এতে অন্তর্ভুক্ত করে না চীন। করোনার উৎপত্তি সংক্রান্ত বিরোধ নিয়ে অস্ট্রেলিয়া থেকে ২০২০ সালে গরুর মাংস, মদ ও যব আমদানি স্থগিত করে চীন। কিন্তু সেসময় ইস্পাত তৈরির কাঁচামালের যোগান দেওয়ার জন্য লোহার আকরিকের আমদানি ঠিকই তারা অব্যাহত রেখেছিল।
ভবিষ্যতে চীন কি তাইওয়ানের সেমিকন্ডাক্টর খাতকে লক্ষ্যবস্তু বানাবে?
কতদিন তাইওয়ানের সেমিকন্ডাক্টর শিল্পের আধিপত্য থাকবে তা এখনো অনিশ্চিত।
চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বিদেশি প্রযুক্তির ওপর নির্ভরতাকে দেশের মুখোমুখি হওয়া ‘লুকানো ভয়ানক বিপদ’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। একই সঙ্গে তিনি এ খাতে স্বনির্ভরতা বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
‘মেড ইন চায়না’ উদ্যোগের অংশ হিসেবে বেইজিং ২০২০ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে সেমিকন্ডাক্টরসহ হাই-টেক ইন্ডাস্ট্রিতে ১.৪ ট্রিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
টেকনডের গবেষণা অনুযায়ী, শুধু ২০২০ সালেই চীনের সেমিকন্ডাক্টর কোম্পানিগুলো ২২৭.৬ বিলিয়ন ইউয়ান (৩৩.৭ বিলিয়ন ডলার) বিনিয়োগ পেয়েছে। যা আগের বছরের তুলনায় চারগুণ বেশি।
সরকারি তথ্য অনুসারে, গত বছর চীনের ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট উৎপাদন বেড়েছে ৩৫৯.৪ বিলিয়ন ইউনিট। যা আগের বছরের চেয়ে ৩৩.৩ সতাংশ বেশি।
তাইওয়ানের অ্যাকাডিমিয়া সিনিকার অ্যাসিস্ট্যান্ট রিসার্চ ফেলো লি বলেন, আমার মনে হয় তাইওয়ানের সেমিকন্ডাক্টর শিল্পের ওপর এখনই নিষেধাজ্ঞা দেবে না চীন। কেননা, তারা তাইওয়ানের এ শিল্পের ওপর নির্ভরশীল। এ অবস্থান তখন বদলাবে যখন বেইজিং শক্তিশালী উৎপাদন ক্ষমতা অর্জন করতে পারবে। তবে, আমার দৃষ্টিতে এমন পর্যায়ে পৌঁছেতে আরও বহু বছর বাকি।