বিশেষ: ইন্টারনেটের মানচিত্র বদলে দিচ্ছে লাইক বাটন, হচ্ছে কোটি কোটি টাকার ব্যবসা?

একটি ছোট্ট ‘থাম্বস-আপ’ চিহ্ন, যা একসময় কেবল ‘পছন্দ’ জানানোর প্রতীক ছিল—সেই ‘লাইক’ বাটন এখন আমাদের অনলাইন যোগাযোগের ধরন, অনুভূতি প্রকাশের ভাষা এবং ডিজিটাল দুনিয়ার ব্যবসার ভিত্তিকেই আমূল বদলে দিয়েছে। সম্প্রতি প্রকাশিত ‘লাইক : দ্য বাটন দ্যাট চেঞ্জড দ্য ওয়ার্ল্ড’ নামের একটি বইয়ে এই সাধারণ বাটনটির সামাজিক যোগাযোগের বিশাল প্রভাবক হয়ে ওঠার কাহিনি তুলে ধরা হয়েছে।

‘লাইক’ বাটনের জন্মকথা
২০০৫ সালের ১৮ মে, ইয়েল্প (Yelp) নামের একটি রিভিউ সাইটের কর্মী বব গুডসন প্রথম একটি স্কেচ করেন—একইসাথে একটি থাম্বস-আপ ও একটি থাম্বস-ডাউন চিহ্ন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল, ব্যবহারকারীরা যেন রেস্টুরেন্ট রিভিউতে সহজে প্রতিক্রিয়া জানাতে পারেন। যদিও ইয়েল্প এই আইডিয়া গ্রহণ করেনি, তবে একই সময়ে গুগল, ইউটিউব ও টুইটারের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোও অনলাইনে সহজ রিঅ্যাকশনের উপায় খুঁজছিল। এই সম্মিলিত চিন্তা থেকেই জন্ম নেয় ‘লাইক’ বাটনের ধারণা।

প্রথমদিকে ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জুকারবার্গ ‘লাইক’ বাটনের পক্ষে ছিলেন না। তিনি মনে করতেন, এতে ফেসবুকের গুরুত্ব হালকা হয়ে যেতে পারে। তবে, নানা আলোচনা-সমালোচনার পর ২০০৯ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি, আনুষ্ঠানিকভাবে এটি ফেসবুক চালু করে।

ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের চালিকাশক্তি
‘লাইক’ বাটন চালু হওয়ার পর থেকেই এটি ফেসবুক কনটেন্ট অ্যালগরিদম, বিজ্ঞাপন এবং ব্যবহারকারীর আগ্রহ বিশ্লেষণের মূল মাধ্যম হয়ে ওঠে। বর্তমানে মেটা (ফেসবুকের মূল সংস্থা) শুধুমাত্র বিজ্ঞাপন থেকেই বছরে প্রায় ১৬ হাজার ৫০০ কোটি ডলার আয় করছে, যার অনেকটাই এই ‘লাইক’ নির্ভর ডেটার উপর নির্ভরশীল।

ফেসবুকের পথ অনুসরণ করে ইউটিউব, ইনস্টাগ্রাম, টুইটারসহ সব বড় প্ল্যাটফর্মেই ‘লাইক’ বা সমমানের বাটন যুক্ত হয়। ২০১৬ সালে ফেসবুক আরও ছয়টি রিঅ্যাকশন (লাভ, কেয়ার, হাহা, ওয়াও, স্যাড, অ্যাংরি) যুক্ত করে ব্যবহারকারীদের অনুভূতি প্রকাশের সুযোগ আরও বাড়ায়।

এই ছোট ক্লিকগুলোই এখন নির্ধারণ করে দেয় কোন কনটেন্ট বেশি মানুষের কাছে পৌঁছাবে, কোন পোস্ট ভাইরাল হবে। এটি হয়ে উঠেছে ডিজিটাল মার্কেটিং এবং কনটেন্ট অপ্টিমাইজেশনের এক অপরিহার্য হাতিয়ার।

ইতিবাচকতার আড়ালে লুকিয়ে থাকা অন্ধকার দিক
তবে, ‘লাইক’ বাটনের সবকিছুই যে ইতিবাচক, তা নয়। এর নেতিবাচক প্রভাবও কম নয়। গবেষণায় দেখা গেছে, অনেক কিশোর-কিশোরী সোশ্যাল মিডিয়ায় কম লাইক পাওয়ার কারণে হতাশায় ভোগে। অনেকে লাইক না পেয়ে নিজেদের মূল্যায়ন নিয়ে সন্দিহান হয়ে পড়ে, যা মানসিক স্বাস্থ্যের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে।

‘লাইক’ বাটনের প্রাচীন ঐতিহ্য
‘লাইক’ বাটনের উৎপত্তির ইতিহাস আরও প্রাচীন। রোমান যুগের গ্ল্যাডিয়েটর যুদ্ধ থেকে শুরু করে ‘হ্যাপি ডেজ’ টিভি সিরিজে ফনজি চরিত্র পর্যন্ত—’থাম্বস-আপ’ (thumbs-up) চিহ্নটি পছন্দ প্রকাশে বহুবার ব্যবহৃত হয়েছে।

বইটির সহলেখক মার্টিন রিভস বলেন, “লাইক বাটন আমাদের সেই প্রাচীন মানসিক চাহিদাটিকেই ছুঁয়ে যায়—আমরা চাই কেউ আমাদের পছন্দ করুক, বুঝুক এবং পাশে থাকুক।”

Related Posts

© 2025 Tech Informetix - WordPress Theme by WPEnjoy