
বিশ্বব্যাপী উৎপাদন খাত এক নতুন বিপ্লবের সাক্ষী হচ্ছে, যেখানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই), ইন্টারনেট অব থিংস (আইওটি) এবং স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তি উৎপাদন প্রক্রিয়াকে আমূল বদলে দিচ্ছে। এই ধারাবাহিকতায় চীন পৃথিবীকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয় ‘ডার্ক ফ্যাক্টরি’র সঙ্গে—যে কারখানায় কোনো শ্রমিকের প্রয়োজন নেই, এমনকি আলোও লাগে না। সপ্তাহে ৭ দিন, ২৪ ঘণ্টা নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করতে সক্ষম এই কারখানাগুলো উৎপাদনশীলতা, নির্ভুলতা এবং খরচ নিয়ন্ত্রণে এক নতুন মানদণ্ড স্থাপন করছে। এমইএস-এর খবরে এ তথ্য প্রকাশিত হয়েছে।
কী এই ডার্ক ফ্যাক্টরি?
‘ডার্ক ফ্যাক্টরি’ হলো এমন একটি আধুনিক উৎপাদন কেন্দ্র, যেখানে সমস্ত কার্যক্রম স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরিচালিত হয়। এখানে মানুষের কোনো হস্তক্ষেপের প্রয়োজন পড়ে না। রোবটিক সিস্টেম, এআই-চালিত মেশিন এবং আইওটি প্রযুক্তির মাধ্যমে এসব কারখানা নিয়ন্ত্রিত হয়। মানুষের অনুপস্থিতির কারণে আলোরও প্রয়োজন হয় না, যা বিদ্যুৎ সাশ্রয় এবং কার্যকারিতা বাড়ায়। এই কারখানায় কাঁচামাল ব্যবস্থাপনা থেকে শুরু করে অ্যাসেম্বলি, প্যাকেজিং এবং গুণগত মান যাচাই—সবকিছুই এআই ও রোবটের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। ফলে উৎপাদন প্রক্রিয়া দ্রুততর হয় এবং মানবিক ভুলের সম্ভাবনা একেবারেই থাকে না।
প্রযুক্তির কারিশমা
ডার্ক ফ্যাক্টরির মূল শক্তি হলো এর শতভাগ স্বয়ংক্রিয়তা। আইওটি-চালিত যন্ত্রপাতি একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সমন্বয় সাধন করে, রক্ষণাবেক্ষণের প্রয়োজনীয়তা পূর্বাভাস দেয় এবং উৎপাদন কার্যক্রম নির্বিঘ্ন রাখে। এআই-নির্ভর মান নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা মেশিন লার্নিং অ্যালগরিদমের মাধ্যমে প্রতিটি পণ্যের গুণগত মান নিশ্চিত করতে নিরবচ্ছিন্ন পর্যবেক্ষণ চালায়। এতে ত্রুটিপূর্ণ পণ্য উৎপাদনের হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়।
এছাড়া, এই কারখানাগুলোর পরিবেশ পরিষ্কার ও দূষণমুক্ত। বিশেষ করে ইলেকট্রনিকস এবং ফার্মাসিউটিক্যাল শিল্পের জন্য এতে স্বয়ংক্রিয় বাতাস পরিশোধন ব্যবস্থা থাকে, যা দূষণমুক্ত উৎপাদন নিশ্চিত করে। স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তির ফলে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে একাধিক পণ্য তৈরি করা সম্ভব হয়, যা বড় পরিসরে উৎপাদন পরিচালনার সুযোগ সৃষ্টি করে।
সুবিধা ও টেকসইতা
ডার্ক ফ্যাক্টরির ২৪ ঘণ্টা নিরবচ্ছিন্ন উৎপাদন ক্ষমতা কোম্পানিগুলোকে দ্রুত চাহিদা পূরণে সক্ষম করে। স্বয়ংক্রিয় পর্যবেক্ষণের ফলে পণ্যের ত্রুটি কমে এবং গুণগত মান উন্নত হয়। এছাড়া, এই কারখানাগুলো বিদ্যুৎ ব্যবহারের মাত্রা স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিয়ন্ত্রণ করে, যা খরচ কমানোর পাশাপাশি পরিবেশবান্ধব উৎপাদন নিশ্চিত করে। বিদ্যুৎ ও সম্পদের কার্যকর ব্যবহার টেকসই উৎপাদন ব্যবস্থার পথ প্রশস্ত করছে।
শিল্পে বৈপ্লবিক পরিবর্তন
চীনের এই ডার্ক ফ্যাক্টরি শিল্প খাতে বড় ধরনের পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। চীন ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশগুলো এ ধরনের অত্যাধুনিক কারখানা গড়ে তুলতে বিপুল বিনিয়োগ করছে। চীনের কোম্পানি শাওমি ইতিমধ্যে এমন একটি কারখানা চালু করেছে, যেখানে প্রতি সেকেন্ডে একটি স্মার্টফোন উৎপাদন সম্ভব। এই প্রযুক্তি ইলেকট্রনিক্স, গাড়ি নির্মাণ এবং অন্যান্য উচ্চ প্রযুক্তির শিল্পে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে।
শ্রমবাজারে প্রভাব
ডার্ক ফ্যাক্টরির প্রসার শ্রমবাজারে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনবে। প্রচলিত শ্রমিকের প্রয়োজনীয়তা কমে যাওয়ায় কর্মসংস্থানে হ্রাস দেখা যাবে। তবে এআই, রোবটিক্স এবং ডেটা সায়েন্সে দক্ষ পেশাদারদের চাহিদা বাড়বে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, শ্রমিকদের পুনঃপ্রশিক্ষণের মাধ্যমে এই পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়া সম্ভব।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
চীনের ডার্ক ফ্যাক্টরি বিশ্ব উৎপাদন খাতে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। এই প্রযুক্তি কেবল উৎপাদনশীলতা ও লাভ বাড়াবে না, বরং পরিবেশ সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। তবে এর সঙ্গে সামাজিক ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় নীতিনির্ধারকদের প্রস্তুতি নিতে হবে। বিশ্ব এখন চীনের এই বিপ্লবের দিকে তাকিয়ে—যা শিল্প জগতের ভবিষ্যৎ গড়ে দেবে।