সহিংসতা-জর্জরিত শ্রীলঙ্কায় কারফিউয়ের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। আজ বুধবার সকালে দেশব্যাপী জারি করা কারফিউ জারি করা হলেও তা আগামীকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে বলে শ্রীলঙ্কার একটি নিউজ পোর্টাল জানিয়েছে। এদিকে দেশটিতে সহিংসতা রোধে দেখামাত্র গুলির নির্দেশ দিয়েছে দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়।
মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ওই দেশের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জারি করা বিবৃতিতে বলা হয়েছে, সহিংসতা ঠেকাতে ‘দেখামাত্র গুলির’ নির্দেশ দেয়া হয়েছে সশস্ত্র বাহিনীকে।
সদ্য পদত্যাগী প্রধানমন্ত্রী মহিন্দা রাজাপাকসে পূর্ব উপকূলের ত্রিঙ্কোমালি নৌঘাঁটিতে আশ্রয় নিয়েছেন খবর পেয়েই সেখানে শুরু হয়েছে বিক্ষোভ। কয়েক হাজার আন্দোলনকারী নৌঘাঁটি ঘিরে ফেলেছে বলে ওই দেশের সংবাদমাধ্যম জানাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে ‘দেখামাত্র গুলির’ সরকারি ফরমান প্রাণহানি বাড়াতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বস্তুত, গত ৪৮ ঘণ্টার পরিস্থিতি দেখে শ্রীলঙ্কায় ফের গৃহযুদ্ধের আশঙ্কা দেখছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের একাংশ।
মঙ্গলবার সকালে মহিন্দার সরকারি বাসভবন ‘টেম্পল ট্রিজ’ ঘিরে ফেলেন বিক্ষোভকারীরা। বিপুলসংখ্যক সেনাসদস্য রাজপাকসের বাসভবনে পৌঁছে সপরিবার তাকে উদ্ধার করে। সংবাদ সংস্থা এএফপি-কে সেনার এক শীর্ষ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বিক্ষোভকারীরা বিদায়ী প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের গেট ভেঙে ঢোকার চেষ্টা করেছিল। বেশ কয়েকটি গাড়িতে আগুনও ধরিয়ে দেয় তারা। কিন্তু তার আগে কাকভোরেই সদ্য-বিদায়ী প্রধানমন্ত্রীকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।
রাজাপাকসার বাসভবনে হামলা
মঙ্গলবার সকালে রাজপাকসের সরকারি বাসভবন ঘিরে ফেলে বিক্ষোভকারীরা। তারা কলম্বোর টেম্পল ট্রিজ নামের বাসভবনের মূল দোতলা ভবনে প্রবেশ করার চেষ্টা করছিল। রাজাপাকসে ও তার পরিবারের ঘনিষ্ঠ সদস্যরা সেখানেই অবস্থান করছিলেন। এ সময় বিপুলসংখ্যক সেনাসদস্য রাজপাকসের বাসভবনে পৌঁছে সপরিবার তাকে উদ্ধার করে। সংবাদ সংস্থা এএফপি-কে সেনাবাহিনীর এক শীর্ষ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বিক্ষোভকারীরা বিদায়ী প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের গেট ভেঙে ঢোকার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু ভোরেই সপরিবার রাজাপাকসেকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে সে সম্পর্কে খোলসা করেননি তিনি। যদিও সূত্রের খবর, ত্রিঙ্কোমালিতে নৌঘাঁটিতে আশ্রয় নিয়েছেন রাজাপাকসে।
এর আগে জনতা হাম্বানতোতায় রাজাপাকসাদের পৈত্রিক বাসভবনটি জ্বালিয়ে দেয়।
ঠিকমতো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা হলে এই ঘটনা ঘটত না :অর্জুন রানাতুঙ্গা
শ্রীলঙ্কার সাবেক ক্রিকেটার অর্জুন রানাতুঙ্গে বলেন, শান্তিপূর্ণ ভাবে প্রতিবাদ জানাচ্ছিল মানুষ। কিন্তু তাদের ওপর যেভাবে আক্রমণ করা হলো তা অপ্রত্যাশিত। পুলিশ বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছে। বিভোক্ষকারীদের শান্ত করার চেষ্টা করেনি। যদি ঠিক মতো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা হতো, তা হলে এই ঘটনা ঘটত না।
থমথমে কলম্বো
সোমবারে ঘটনার পর থেকেই থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে রাজধানী কলম্বোতে। ওই দিন কারফিউ উপেক্ষা করে রাস্তায় নেমেছিল হাজার হাজার বিক্ষোভকারী। দোকান, বাড়ি, সরকারি কার্যালয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। হামলা চালানো হয় সরকারপক্ষের এমপি এবং নেতাদের বাড়িতে।
এদিকে বিক্ষোভকারী এবং শ্রীলঙ্কার ধর্মীয় নেতারা রাজাপাকসের পরিবারের সমর্থকদের বিক্ষোভকারীদের ওপর হামলা চালানোর জন্য উস্কানি দেয়ার জন্য দোষারোপ করেন। তারা বলেন, ওই হামলার জন্যই প্রতিশোধমূলক হামলার জন্ম নিয়েছে।
বাড়িতে আগুন এবং গুলি
সোমবার দিনভর বিক্ষোভের পর রাত গভীর হতে থাকলে সরকারবিরোধী বিক্ষোভকারীরা সরকার সমর্থক এবং সরকার দলীয় সংসদ সদস্যদের লক্ষ্য করে হামলা চালাতে শুরু করেন।
শ্রীলঙ্কার পুলিশ জানিয়েছে, বিক্ষোভকারীরা কলম্বোর উপকণ্ঠে একজন সরকার দলীয় এমপি অমরাকীর্তি আথুকোরালার গাড়িতে হামলা চালালে তিনি দুজনকে গুলি করেন। এতে একজন মারা যান।
এরপর সরকারবিরোধী বিক্ষোভকারীরা তাকে ঘিরে ধরেন। পরে নিজের পিস্তল দিয়ে আত্মহত্যা করেন ওই সংসদ সদস্য।
রাত বাড়ার সাথে সাথে দেশের বিভিন্ন জায়গায় রাজাপাকসের বাড়িতে, বিভিন্ন মন্ত্রী এবং সংসদ সদস্যদের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়।
মন্ত্রী সানাৎ নিশান্তার বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয় বিক্ষোভকারীরা। এর মধ্যে হাম্বানটোটায় রাজাপাকসের পরিবারের নিজস্ব একটি বাড়ি যা একটি বিতর্কিত জাদুঘরে রূপান্তরিত করা হয়েছিল, সেটিও পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে।
সামাজিক মাধ্যমে বিভিন্ন ভিডিও ফুটেজে দেখা যাচ্ছে, বাড়িগুলো ঘিরে আগুনের লেলিহান শিখা ঘিরে মানুষজন উল্লাস করছে।
প্রেসিডেন্টের সরকারি বাসভবনের চারপাশের এলাকাতেও আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়েছে বলে জানা যাচ্ছে।
বিবিসির আনবারাসন এথিরাজন জানাচ্ছেন, কলম্বোজুড়ে উত্তেজনা চলছে। দেশটির বিমানবন্দরে যাওয়া এবং আসার সড়কগুলোতে লাঠি এবং রড নিয়ে অবরোধ সৃষ্টি করা হয়েছে।
স্বাভাবিক সময়ে ওই রাস্তাগুলোতে পুলিশ এবং নিরাপত্তা বাহিনীর যেমন উপস্থিতি দেখা যায়, এখন তা দেখা যাচ্ছে না।
১৯৪৮ সালে ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা পাওয়ার পর সবচেয়ে ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকট পাড় করছে শ্রীলঙ্কা। জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ মানুষ ব্যাপক ক্ষুব্ধ। সরকার জরুরি আর্থিক সহায়তার আবেদন জানিয়েছে।
অর্থনৈতিক দুরবস্থার জন্য কোভিডকে দায়ী করেছে সরকার, মহামারিতে দেশটির পর্যটন বাণিজ্য যা শ্রীলঙ্কার অন্যতম বৃহৎ বৈদেশিক আয়ের উৎস, তা প্রায় ধসিয়ে দিয়েছে।
কিন্তু বিশ্লেষকেরা মনে করেন, অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনাই এর অন্যতম কারণ।
সূত্র : আলজাজিরা, বিবিসি,