নভোচারীরা মহাকাশ অভিযানে এমন এক অবস্থায় বাস করেন যেখানে কোনও উপর-নীচ নেই, হাঁটার বদলে ভেসে থাকেন ও দেহের ওপর মাধ্যাকর্ষণের কোনও প্রভাব পড়ে না।
মহাকাশে বাসকারী নভোচারীদের জন্য এটাই বাস্তবতা। শুনতে মজার হলেও, মাইক্রোগ্রাভিটিতে থাকার বিষয়টি ওজনহীনতারই নামান্তর, আর এ অবস্থা মানবদেহের উপর যে প্রভাব তা সম্পর্কে অনেকেরই জানা নেই।
মানুষ কীভাবে দীর্ঘ সময় ধরে মহাকাশে অবস্থান করে ও সেখানে কাজ করে তা আরও ভালভাবে বুঝতে কয়েক দশক ধরে মাইক্রোগ্রাভিটির নানা প্রভাব নিয়ে গবেষণা করছেন বিজ্ঞানীরা।
মাইক্রোগ্রাভিটি কীভাবে দেহে প্রভাব ফেলে ও গবেষকরা এখন পর্যন্ত এ সম্পর্কে কী শিখেছেন তা উঠে এসেছে বিজ্ঞানভিত্তিক সাইট নোরিজের এক প্রতিবেদনে।
মাইক্রোগ্র্যাভিটির অন্যতম প্রভাব হচ্ছে, দেহের আকার পরিবর্তন করতে পারে এটি। পৃথিবীতে মাধ্যাকর্ষণ শক্তি দেহের রক্ত ও অন্যান্য তরল পদার্থকে নীচের দিকে টেনে নেয়। তবে মাইক্রোগ্রাভিটির পরিস্থিতিতে দেহের যেসব তরল নীচের দিকে থাকার কথা, সেগুলো শরীরের ভেতরে উপরের দিকে চলে যায়। এ কারণে বেশিরভাগ সময় মহাকাশে নভোচারীদের মুখে ‘ফোলাভাব’ দেখা যায়। দেহের তরল পদার্থের পরিবর্তনের ফলে মাথায় চাপ বাড়তে পারে, যা তাদের দৃষ্টিশক্তির উপরও প্রভাব ফেলে।
মহাকাশে সময় কাটানো শেষে পৃথিবীতে ফিরে আসার পর দৃষ্টিশক্তি ঝাপসা বা পরিষ্কার করে দেখতে অসুবিধার কথা জানিয়েছেন কিছু নভোচারী। যেটিকে বলা হচ্ছে ‘স্পেসফ্লাইট-অ্যাসোসিয়েটেড নিউরো-অকুলার সিনড্রোম’ বা এসএএনএস। দীর্ঘ মহাকাশ অভিযানে কীভাবে নভোচারীদের চোখ বাঁচানো যায় তা বের করার জন্য এ রোগ নিয়ে গবেষণা করছে যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা।
দেহের পেশী ও হাড়ের ওপর প্রভাব ফেলে মাইক্রোগ্র্যাভিটি। মাধ্যাকর্ষণ শক্তির অবিরাম টান ছাড়া দেহের বিভিন্ন পেশীকে ততটা কঠোর পরিশ্রম করতে হয় না, ফলে ক্ষয় হয় পেশীর। একইভাবে হাড়গুলো ঘনত্ব হারাতে শুরু করে। কারণ, পৃথিবীর মতো মহাকাশে ওজন বহন করে না এগুলো। গবেষণায় দেখা গেছে, মহাকাশে প্রতি মাসে হাড়ের ঘনত্ব এক শতাংশ পর্যন্ত কমে যেতে পারে নভোচারীদের।
এ পরিস্থিতি ঠেকানোতে মহাকাশে থাকাকালীন প্রতিদিন ব্যায়াম করেন নভোচারীরা। এজন্য বিশেষভাবে তৈরি টুল যেমন রেজিস্ট্যান্স মেশিন ও ট্রেডমিল ব্যবহার করে ব্যায়াম করেন তারা। এমনকি ব্যায়ামের মাধ্যমেও, পেশী ও হাড়ের শক্তি ফিরে আসতে কয়েক মাস সময় লাগতে পারে।
হার্ট ও সংবহনতন্ত্রও মাইক্রোগ্র্যাভিটিতে বদলে যায়। পৃথিবীতে পুরো শরীর জুড়ে রক্ত পাম্প করার জন্য মাধ্যাকর্ষণের বিরুদ্ধে কাজ করে হৃদপিণ্ড। তবে মহাকাশে অতটা কঠোর পরিশ্রম করতে হয় না হার্টকে। তাই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আকারে কিছুটা ছোট হয়ে যেতে পারে হার্ট। রক্তচাপ ও রক্তের পরিমাণেও পরিবর্তন অনুভব করেন নভোচারীরা।
গবেষণায় দেখা গেছে, দেহের এসব পরিবর্তন অস্থায়ী হলেও পৃথিবীতে ফিরে আসার পর তা চ্যালেঞ্জিং হতে পারে তাদের জন্য। যেমন– কিছু নভোচারী পৃথিবীতে ফিরে আসার পর উঠে দাঁড়ালে হালকা মাথা ব্যথা বা মাথা ঘোরা অনুভব করেন। কারণ, তাদের শরীর তখন পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তির সঙ্গে সামঞ্জস্য করার চেষ্টা করে।
আরেকটি উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা। গবেষণায় দেখা গেছে, মাইক্রোগ্রাভিটি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে দুর্বল করে দিতে পারে, যা সংক্রমণের ঝুঁকিতে ফেলে নভোচারীদের। এর কারণ কিছু রোগ প্রতিরোধী কোষ মহাকাশে সক্রিয়তা হারায়, আবার কিছু কোষ অস্বাভাবিক আচরণও করে।
এ ছাড়াও খুব সীমিত জায়গায় থাকার চাপ, ঘুমে ব্যাঘাত ঘটা ও মহাজাগতিক বিকিরণের সংস্পর্শে আসার ফলে নভোচারীদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যেতে পারে। মহাকাশ অভিযানের সময় রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে কার্যকর করার উপায় খুঁজে বের করতে কাজ করছেন বিজ্ঞানীরা, যেমন নতুন ওষুধ তৈরি করা বা মহাকাশচারীদের খাদ্যাভ্যাস উন্নত করা।
মস্তিষ্ক ও স্নায়ুতন্ত্রের ওপরও প্রভাব ফেলতে পারে মাইক্রোগ্র্যাভিটি। মহাকাশে ভাসমান অবস্থায় থাকার ফলে শরীরের ভারসাম্য ব্যবস্থা থেকে তথ্য প্রক্রিয়ার পদ্ধতি পরিবর্তন করে মস্তিষ্ক। যেটি স্পেস মোশন সিকনেসের দিকে নিয়ে যেতে পারে নভোচারীদের।
এ পরিস্থিতি বেশিরভাগ নভোচারী কয়েক দিনের মধ্যে মানিয়ে নিতে পারেন। তবে পৃথিবীতে ফিরে আসার পর দেহের ভারসাম্য ও সমন্বয়ের বিভিন্ন পরিবর্তন পুরোপুরি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে সময় লাগতে পারে।
এসব চ্যালেঞ্জের পরও মাইক্রোগ্র্যাভিটি কীভাবে মানবদেহে প্রভাব ফেলে তা বোঝা বিজ্ঞানীদের ভবিষ্যতের মহাকাশ অনুসন্ধানের জন্য প্রস্তুত করতে সহায়তা করছে। আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন বা আইএসএস নিয়ে গবেষণা গুরুত্বপূর্ণ ধারণা দিয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে নভোচারীরা প্রায় এক বছর ধরে মহাকাশে অবস্থান করেছেন এমন মিশনের ডেটা।
সবচেয়ে পরিচিত গবেষণার মধ্যে অন্যতম নভোচারী স্কট কেলিকে নিয়ে করা গবেষণাটি। এ গবেষণায় কেলিকে অন্তর্ভূক্ত করার ফলে বিরল এক সুবিধা মিলেছে গবেষকদের জন্য। তার একটি জমজ ভাই আছে!
নাসার ‘টুইনস’ গবেষণার অংশ হিসাবে আইএসএস-এ ৩৪০ দিন কাটিয়েছিলেন তিনি। পৃথিবীতে থাকা তার যমজ ভাইয়ের সঙ্গে স্কটকে তুলনা করে ডিএনএ থেকে শুরু করে মানসিক স্বাস্থ্য পর্যন্ত সবকিছুর উপর তার দীর্ঘমেয়াদী মহাকাশ ভ্রমণের নানা প্রভাব মিলিয়ে দেখেছেন গবেষকরা।
মাইক্রোগ্র্যাভিটি নিয়ে গবেষণার বিষয়টি কেবল মহাকাশ ভ্রমণ সম্পর্কে নয়, বরং পৃথিবীর মানুষের জন্যও উপকারী। যেমন– নভোচারীদের হাড়ের ক্ষয় নিয়ে করা গবেষণা অস্টিওপরোসিস রোগের চিকিৎসার উন্নতি করেছে।