
ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ (IPL) শুধুমাত্র ক্রিকেটীয় উন্মাদনার এক বিশাল মঞ্চ নয়, অনেকের কাছে এটি হয়ে উঠেছে রাতারাতি ধনী হওয়ার এক প্রলোভনীয় সুযোগ। কিন্তু দ্রুত অর্থ উপার্জনের এই লোভ, ভারতীয় তরুণ প্রজন্মকে ঠেলে দিচ্ছে জুয়ার ভয়ংকর আসক্তির অতল গহ্বরে। মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইপিএলে বাজি ধরা এখন ভারতীয় তরুণদের মধ্যে এক গুরুতর আসক্তিতে পরিণত হচ্ছে, যার সামাজিক এবং ব্যক্তিগত মূল্য অপরিসীম।
গুগল সার্চ ট্রেন্ডস এই ভয়াবহ বাস্তবতাকে আরও প্রকট করে তুলছে। প্রতি আইপিএল মরসুমে ‘IPL Addiction’ এবং ‘Online Betting’-এর মতো শব্দগুলির জন্য সার্চের পরিমাণ আকাশ ছুঁচ্ছে। শুধু তাই নয়, ‘Gambling Addiction’-এর মতো সার্চও ২০১৫ সাল থেকে ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়েছে, যা অনলাইন বেটিং অ্যাপগুলির লাগামহীন জনপ্রিয়তার দিকে ইঙ্গিত করে।
কিসের খোঁজে তরুণ প্রজন্ম?
গুগল ট্রেন্ডস-এর তথ্য অনুযায়ী, ব্যবহারকারীরা কেবল বাজি ধরছে না, তারা এই আসক্তি থেকে মুক্তিও খুঁজছে। ‘Causes of Gambling Addiction’, ‘is gambling an addiction’, ‘Online Gambling Addiction’ এবং ‘Gambling Addiction therapy’-এর মতো প্রশ্নগুলির জন্য সার্চ বাড়ছে। এর পাশাপাশি, জুয়ার আসক্তির চিকিৎসা, জুয়ার আসক্তি থেকে কীভাবে মুক্তি পাওয়া যায় এবং জুয়ার আসক্তির চিকিৎসার মতো বিষয়গুলিও দ্রুত গতিতে খোঁজা হচ্ছে। এই প্রবণতা স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয় যে, সমস্যাটি গভীর এবং মানুষ এর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে।
আইনি ধূসর এলাকা এবং উদ্বেগের ক্রমবর্ধমান সুর
খেলাধুলা-ভিত্তিক ফ্যান্টাসি অ্যাপগুলির আইনি অবস্থা ভারতে এখনও এক ধোঁয়াশার মধ্যে। সমালোচকরা বলছেন, এই অ্যাপগুলি প্রকাশ্যে জুয়ার আসক্তি প্রচার করছে, বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে। সম্প্রতি, একটি জনস্বার্থ মামলার শুনানির সময় সুপ্রিম কোর্ট আইপিএল চলাকালীন বাজি ধরা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। আদালত সরাসরি বলেছে, “আইপিএলের নামে অনেকেই বাজি ধরছে এবং জুয়া খেলছে। এটি একটি গুরুতর বিষয়।”
ভারতে জুয়া সংক্রান্ত আইন প্রতিটি রাজ্যে ভিন্ন। অনলাইন বাজি ধরার বিষয়ে কোনও স্পষ্ট কেন্দ্রীয় আইন না থাকায় এই অ্যাপগুলির আইনি অবস্থান নির্ভর করে খেলাটিকে দক্ষতার খেলা নাকি সুযোগের খেলা হিসেবে বিবেচনা করা হয় তার উপর। পূর্বে সুপ্রিম কোর্ট রামি এবং ফ্যান্টাসি খেলাগুলিকে দক্ষতার খেলা হিসেবে গণ্য করেছে, তাই এগুলিকে ঐতিহ্যবাহী জুয়া আইনে অন্তর্ভুক্ত করা হয় না। এই আইনি ফাঁকই অনলাইন বেটিং অ্যাপগুলিকে অবাধে বিস্তার লাভ করতে সাহায্য করছে বলে মনে করছেন অনেকে।
অনলাইন জুয়ার ভয়াবহ পরিণতি
অনলাইন জুয়ার প্রভাব দিন দিন বেড়েই চলেছে। প্রায়শই খবরে এমন ঘটনা উঠে আসে যেখানে জুয়ার কারণে কিশোর এবং যুবকরা বিশাল ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। এর মর্মান্তিক উদাহরণ হিসেবে ২০২৫ সালের মার্চ মাসের ঘটনাটি উল্লেখ করা যায়, যখন বেঙ্গালুরুর একজন আইটি পেশাদার বাজি ধরার জন্য ১.৫ কোটি টাকা হারিয়েছিলেন। জুয়ার জন্য ঋণ নিয়েছিলেন তিনি, এবং ঋণদাতাদের হয়রানির শিকার হয়ে তাঁর স্ত্রী আত্মহত্যা করতে বাধ্য হন।
এই ধরনের ঘটনা সামনে আসার পর থেকে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ এবং পরামর্শদাতাদের কাছে সাহায্য চাওয়া মানুষের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। দিল্লির মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ আরুবা কবির জানান, প্রতি মাসে ৩ থেকে ৫ জন রোগী আইপিএল বা অন্যান্য খেলাধুলায় বাজি ধরার আসক্তির অভিযোগ নিয়ে তাঁর কাছে আসেন, বিশেষ করে ক্রিকেটের মরসুম এবং বড় টুর্নামেন্টের সময়। তিনি বলেন, আইপিএল চলাকালীন এই সংখ্যা আরও বেড়ে যায়, কারণ অ্যাপগুলি সহজেই পাওয়া যায় এবং বন্ধুদের কাছ থেকেও বাজি ধরার জন্য চাপ থাকে।
খেলাধুলায় বাজি ধরার আসক্তির সাধারণ লক্ষণ:
- বারবার স্কোর পরীক্ষা করা: খেলার প্রতিটি মুহূর্তের উপর অস্বাভাবিক নজর রাখা।
- মনোযোগের অভাব: দৈনন্দিন কাজকর্মে বা পড়াশোনায় মন বসাতে না পারা।
- কর্মক্ষেত্রে পারফরম্যান্স হ্রাস: কাজের মান কমে যাওয়া বা অনুপস্থিতি।
- আর্থিক সঙ্কট: ঋণ নেওয়া, সম্পত্তি বিক্রি করা, লুকানো ঋণ, এমনকি চুরিও।
- পরিবারের কাছ থেকে মিথ্যা বলা বা জিনিস লুকিয়ে রাখা: জুয়ার অভ্যাস লুকাতে পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হওয়া।
এনসো ওয়েলনেসের প্রতিষ্ঠাতা আরুবা কবির সতর্ক করে বলেন, “খেলাধুলায় বাজি ধরার আসক্তিতে মনে হয় যেন আপনি নিয়ন্ত্রণে আছেন এবং সহজেই অর্থ উপার্জন করতে পারেন, তবে এটি মস্তিষ্ককে একটি আসক্তির মতো প্রভাবিত করে। প্রত্যাশা, পুরস্কার এবং ক্ষতির চক্র এটি ছেড়ে দেওয়া কঠিন করে তোলে। পেশাদারদের সাহায্য ছাড়া এটি থেকে বেরিয়ে আসা সহজ নয়।”
যদিও ভারতে অনলাইন জুয়ার প্রকোপ সম্পর্কে কোনো পাবলিক তথ্য নেই, আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশন অনুমান করে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ০.৪ থেকে ৪ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক তাঁদের জীবনের কোনো না কোনো সময়ে জুয়ার আসক্তিতে ভুগতে পারেন। ভারতে এই সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে, বিশেষ করে আইপিএলের মতো জনপ্রিয় ইভেন্টগুলির সময়ে। দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে এই ‘ফাস্ট মানি’র নেশা আরও অনেক তরুণের জীবনকে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দেবে।