পলাশীর যুদ্ধের পর কেন তৈরি হল কলকাতার জলপুলিশ, দেখুন সেই অজানা ইতিহাস

কলকাতা রিভার ট্রাফিক পুলিশ এক অনন্য ঐতিহ্য ও বহুমুখী দায়িত্বের আধার। ব্রিটিশ আমলের রাজধানী কলকাতায় জলপুলিশ বাহিনী গঠনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। সেই সময় থেকে আজও কলকাতার জলে অতন্দ্র পাহারায় দেশের এই একমাত্র রিভার ট্রাফিক পুলিশ। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলেছে তাদের গঠন ও কাজের ধরন। কলকাতা শহরের এই ইউনিট এখন আগের থেকেও বহু গুণ শক্তিশালী।
ঐতিহ্য ও ইতিহাস
পলাশীর যুদ্ধে জয়লাভের পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কলকাতার পুলিশি ব্যবস্থাকে আরও উন্নত করার কাজে নজর দেয়। ১৭ শতকের শেষ দিক থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্য কুঠী হিসেবে কলকাতার সমৃদ্ধির সূত্র ধরে এখানে একটা বিত্তশালী মহল গড়ে ওঠে। সেই বিত্ত দূর-দূরান্ত থেকে টেনে আনে লোকজনকে, তার সঙ্গেই পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে চুরি ও ডাকাতির ঘটনা। এতে কোম্পানির লাভের কড়িতে টান পড়লে কর্মকর্তাদের কপালে চিন্তার ভাঁজ বাড়ে। এরপরই নতুন রূপে গড়ে ওঠা এই শহরের শান্তি ও নিরাপত্তার স্বার্থে ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে পুলিশি ব্যবস্থা।
ঐতিহাসিকদের মতে, ফোর্ট উইলিয়াম, হাওড়ার ডক – সর্বত্রই ছিল এই বাহিনীর নজরদারি। কলকাতা রিভার ট্রাফিক পুলিশের ওসি ইন্দ্র চৌধুরী ইটিভি ভারতকে বলেন, “কলকাতার জলপুলিশের ইতিহাস অনেক পুরনো। আগে এর নাম ছিল পোর্ট-পুলিশ। কলকাতা পুলিশ যেদিন থেকে তৈরি হয়েছে, রিভার ট্রাফিক পুলিশও তার সমসাময়িক। এটা বন্দর বিভাগের অন্তর্গত একটা ইউনিট।”
জলপুলিশের গঠন: অতীত ও বর্তমান
শহর কলকাতার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে এই জলপুলিশি ব্যবস্থা গড়ে তোলা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ছিল। একসময় নয় জন অফিসার, ১৮ জন পিয়োন, ৯২ জন মাঝি ও নয়টি টহলদারি নৌকা ছিল রিভার ট্রাফিক পুলিশের স্বাভাবিক কাঠামো। এরাই সাধারণ মানুষের মুখে ‘জলপুলিশ’ হিসেবে পরিচিত। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে দায়িত্ব। ফলে বহরেও বেড়েছে এই বাহিনী।
সাম্প্রতিক সরকারি তথ্য অনুযায়ী, কলকাতা পুলিশের রিভার ট্রাফিক ইউনিটের কাঠামো আগের তুলনায় অনেক বিস্তৃত ও প্রযুক্তিসম্পন্ন। বর্তমানে ইউনিটে রয়েছেন ইন্সপেক্টর, সার্জেন্ট, সহকারী সাব-ইন্সপেক্টর, মাঝি, ডাণ্ডি ও অন্যান্য পদমর্যাদার সদস্যরা। বর্তমানে কলকাতা রিভার ট্রাফিক পুলিশে রয়েছেন মোট ৪৯ জন। এছাড়াও স্পিডবোট চালক, জেইট স্কি চালক, ডুবুরি, কলকাতা পুলিশের বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী সদস্যরাও রয়েছেন বাহিনীতে।
কাজের ধরনে বিবর্তন
ব্রিটিশদের শাসনকালে জলপুলিশের প্রধান দায়িত্ব ছিল নদীপথে ডাকাতি আটকানো, নৌকাবিরোধ মেটানো, গঙ্গার ঘাট পাহারা দেওয়া ইত্যাদি। তবে সময় বদলেছে, বদলেছে রিভার ট্রাফিক পুলিশের কাজও। এখন নদীতে তলিয়ে যাওয়া থেকে মানুষকে বাঁচানো, ডুবে যাওয়া ব্যক্তিকে উদ্ধার, জলশোধন কেন্দ্র পাহারা দেওয়া, অবৈধ ভাবে মাছ ধরার উপর নজরদারি, দূষণ নিয়ন্ত্রণ, ভাসমান লাশ উদ্ধার, উৎসবের সময় ভিড় সামলানো, জেটি ব্যবস্থাপনা ইত্যাদিই তাদের প্রধান দায়িত্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কলকাতা রিভার ট্রাফিক পুলিশের ওসি ইন্দ্র চৌধুরীর কথায়, “আগে এখানে কাজ একেবারেই আলাদা ছিল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের কাজের ধরন বদলে গিয়েছে। এখন আমরা মূলত উদ্ধারকাজ করে থাকি। আমরা কলকাতা পুলিশের বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করি। এছাড়া শুধুমাত্র মধ্য কলকাতাতেই এই বাহিনী রয়েছে বলে আমরা বেঙ্গল পুলিশ এবং জেলা পুলিশকেও সাহায্য করি।”
বর্তমানে টহল নৌকা, দাঁড় টানা নৌকার বদলে এসেছে মোটরচালিত লঞ্চ, জেট স্কি, আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা ও প্রশিক্ষিত ডুবুরিরা। এখন কাজের ধরন অনেকটাই প্রযুক্তিনির্ভর ও দ্রুততর হয়েছে। গঙ্গার বুকে তারা কেবল ট্র্যাফিক ম্যানেজার নয়, আজকের কলকাতার শহুরে জীবনযাত্রার তারা অবিচ্ছেদ্য পাহারাদার।