বিদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক ও বিদেশ নীতির নতুন সঙ্কট

সুদীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ভারত স্বাধীনতা লাভ করেছিল, যা ছিল আত্মনির্ভরতার প্রতীক। বিভিন্ন জাতি ও ধর্মের মানুষের অংশগ্রহণে গঠিত এই দেশ পরিচালনার কঠিন দায়িত্ব সম্পর্কে মহাত্মা গান্ধী এবং বি আর আম্বেদকরের মতো নেতারা সচেতন ছিলেন। সদ্য স্বাধীন দেশের প্রয়োজন অনুযায়ী একটি বিদেশনীতি তৈরি হয়েছিল, যা মূলত জোটনিরপেক্ষতার উপর ভিত্তি করে ছিল।

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, ভারত সবসময়ই তাদের পাশে ছিল যারা প্রয়োজনের সময় সাহায্য করেছে। ১৯৮০ সাল পর্যন্ত ভারতের বেশিরভাগ ইস্পাত কারখানা রাশিয়ার সহযোগিতায় তৈরি হয়েছিল, যা দুই দেশের বন্ধুত্বের এক বিশেষ দিক। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকা দুই দেশকে বন্ধুত্বের বাঁধনে আবদ্ধ করেছে। ভারতের বিদেশনীতির মূল মন্ত্র ছিল দেশের প্রয়োজনকে গুরুত্ব দেওয়া এবং কোনো একটি জোটের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত না হওয়া।

বর্তমানে বিদেশ নীতির সঙ্কট

তবে স্বাধীনতার এত দশক পর ভারতের বিদেশনীতিতে এক নতুন সংকট দেখা দিয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর ‘বন্ধুত্বপূর্ণ’ সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও ট্রাম্প ভারতীয় পণ্যের উপর ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছেন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী হয়তো ‘বন্ধু’ ট্রাম্পের কাছ থেকে এমন আচরণ আশা করেননি।

কোনো একটি বিশেষ দেশের প্রতি অতিরিক্ত আনুগত্য দেখালে দর কষাকষির জায়গা থাকে না। ভারতের ক্ষেত্রেও সেটাই হচ্ছে। আমেরিকার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার ফলস্বরূপ এই বিপুল শুল্কের বোঝা ভারতের ব্যবসায়ীদের উপর পড়েছে। ট্রাম্প ভারতের আশপাশের দেশগুলোর ওপর এত বেশি শুল্ক আরোপ করেননি। পাকিস্তানের ওপর শুল্কের পরিমাণ ২০ শতাংশ এবং বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তা আরও কম। এর ফলে ভারতীয় ব্যবসায়ীদের কঠিন প্রতিযোগিতার মুখে পড়তে হচ্ছে।

আমেরিকার প্রতি আনুগত্যের আরও একটি উদাহরণ হলো ভারত-পাকিস্তান সংঘাতের পর ট্রাম্পের দাবি, তিনি এই ‘যুদ্ধ’ থামিয়েছেন। যদিও ভারত সরকার সংসদে জানিয়েছে যে, দুই দেশের সামরিক নেতৃত্বের আলোচনার ফলেই সংঘাতের অবসান ঘটেছে। কিন্তু ট্রাম্পের দাবিকে সরাসরি কেউ মিথ্যা বলেনি।

আঞ্চলিক এবং অভ্যন্তরীণ রাজনীতি

বিদেশনীতির এই দুর্বলতার কারণে ভারত তার প্রতিবেশী দেশগুলো, যেমন পাকিস্তান, বাংলাদেশ বা চীনের কাছে আগের মতো সম্মান পাচ্ছে না। কোনো প্রতিবেশী দেশকে ভালো আচরণ করতে বাধ্য করার মতো সেই ‘জোর’ ভারত হারিয়ে ফেলেছে।

বিদেশনীতির ব্যর্থতা দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও প্রভাব ফেলেছে। ‘আচ্ছে দিন আনেওয়ালে হ্যায়’ স্লোগানের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। বিদেশে বিশ্বাস ও আস্থা অর্জনে ব্যর্থতার কারণে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ হয়েছে। বেশিরভাগ বড় সংস্থা কর্মীদের ছাঁটাই করছে এবং সরকার এখন উন্নয়নের রাজনীতির পরিবর্তে পরিচয় ও অনুপ্রবেশের রাজনীতি করতে বাধ্য হচ্ছে।

প্রধানমন্ত্রী মোদী দাবি করেন যে তিনি বিদেশি নেতাদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয়। কিন্তু যদি সত্যিই তা হয়, তাহলে চীন থেকে ভারতে কেন যথেষ্ট বিনিয়োগ আসছে না? চীনা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ব্যক্তিগত সুসম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও আন্তর্জাতিক সীমান্তে উত্তেজনা কেন কমছে না, তা বোঝা কঠিন।

দেশের বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর একজন অত্যন্ত দক্ষ আমলা হলেও, বর্তমানে রাজনৈতিক চাপ তার সিদ্ধান্তগুলোকে প্রভাবিত করছে বলে মনে করা হচ্ছে।