ব্রহ্মপুত্র নদে বিশাল বাঁধ গড়ছে চিন, ভারতের কী বিপদ? জেনেনিন কি বলছে পরিস্থিতি

তিব্বতের বুকে ব্রহ্মপুত্র নদের ওপর বিশ্বের বৃহত্তম জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণ শুরু করেছে চীন, যা ভূ-রাজনৈতিক এবং পরিবেশগত দিক থেকে ভারত ও বাংলাদেশের জন্য গভীর উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত ১৯শে জুলাই থেকে ড্যাম নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে, যার আনুমানিক ব্যয় প্রায় ১৬৭.৮ বিলিয়ন ডলার (কয়েক লক্ষ কোটি ভারতীয় টাকা)। চীনের দাবি, এই মেগা ড্যাম চালু হলে দেশটির প্রায় ৩০ কোটি মানুষ উপকৃত হবেন এবং বছরে ৩০০ বিলিয়ন কিলোওয়াট আওয়ার (kWh) বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব হবে।

**ব্রহ্মপুত্রের U-টার্নে চীনের দানবীয় পরিকল্পনা:**

তিব্বতে ‘য়ারলুং সাংপো’ নামে পরিচিত ব্রহ্মপুত্র নদ যেখানে U-টার্ন নিয়ে ভারতের অরুণাচল প্রদেশ হয়ে অসমে প্রবেশ করেছে, ঠিক সেই স্থানেই এই বিশাল বাঁধ তৈরি হচ্ছে। চীনের পরিকল্পনা অনুযায়ী, নামচা বরওয়া পর্বতমালার মধ্যে দিয়ে ৪ থেকে ৬টি ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ সুড়ঙ্গ তৈরি করে নদীর জলের তীব্র স্রোতকে ঘুরিয়ে দেওয়া হবে। এই নদীর জলের প্রবাহ এতটাই তীব্র যে প্রতি সেকেন্ডে ২,০০০ কিউবিক মিটার জল প্রবাহিত হয়, যা মাত্র ১ সেকেন্ডে তিনটি অলিম্পিক সুইমিং পুল ভরতে সক্ষম।

**ভারতের জন্য কী অপেক্ষা করছে?**

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই মেগা ড্যাম ভারতের জন্য বড় ধরনের ক্ষতির কারণ হতে পারে। চীন কোনো আন্তর্জাতিক জল চুক্তিতে স্বাক্ষর করেনি, ফলে দুই দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত একটি নদীর উপর এভাবে বাঁধ নির্মাণের ক্ষেত্রে তাদের উপর কোনো আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতা নেই। চুক্তি না থাকায়, চীন জলপ্রবাহ সংক্রান্ত তথ্য জানানোরও কোনো দায়বদ্ধতা রাখে না।

এর ফলে, চীন চাইলে যে কোনো সময় বাঁধ তৈরি করে জল আটকে রাখতে পারে। এটি ভারতের উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলি, বিশেষত অরুণাচল প্রদেশ ও অসমে ভয়াবহ বন্যা বা চরম খরা পরিস্থিতির জন্ম দিতে পারে। বাংলাদেশের কৃষিজীবনের একটি বড় অংশ ব্রহ্মপুত্রের উপর নির্ভরশীল হওয়ায়, সেখানেও এর মারাত্মক প্রভাব পড়বে।

**ভূ-রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে জলের ব্যবহার:**

যুদ্ধ বা উত্তেজনার পরিস্থিতিতে চীন এই বাঁধকে একটি ‘সফট’ অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করতে পারে। কৌশলগত দিক থেকে এটি নিঃসন্দেহে ভারতের জন্য একটি বড় ঝুঁকি। ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন, ব্রহ্মপুত্রের জলকে চীন ভবিষ্যতে একটি দর কষাকষির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে পারে।

**পরিবেশ ও ভূমিকম্পের ঝুঁকি:**

পরিবেশবিদরা আশঙ্কা করছেন, এভাবে বাঁধ তৈরির ফলে ব্রহ্মপুত্রের জীববৈচিত্র্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। জলজ প্রাণী, উদ্ভিদ তো বটেই, অসমের এক শৃঙ্গ গন্ডার-সহ বহু বিপন্ন প্রজাতির প্রাণীর অস্তিত্বও সংকটে পড়তে পারে।

এছাড়াও, হিমালয়ের মতো একটি ভূকম্পনপ্রবণ অঞ্চলে এত বিশাল কংক্রিট স্ট্রাকচার নির্মাণ ভূমিকম্পের ঝুঁকি বাড়াতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। বিশাল এই বাঁধের পেছনে একটানা বিপুল পরিমাণ জল জমে থাকলে ভূকম্পনের প্রবণতা বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

**ভারতের করণীয় কী?**

এই পরিস্থিতিতে ভারত সিয়াং নদীর উপর ১১,০০০ মেগাওয়াটের একটি জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজ শুরু করার পরিকল্পনা করেছে, যা চীনের বাঁধের প্রভাব কিছুটা হলেও মোকাবিলায় সহায়ক হতে পারে। তবে স্থানীয়দের বিরোধিতা এক্ষেত্রে একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ভারত ও চীনের মধ্যে এখনও পর্যন্ত কোনো জলবন্টন চুক্তি নেই। তবে, কূটনৈতিক স্তরে চীনের সঙ্গে জলবন্টন সংক্রান্ত আলোচনা চলছে। ২০০৬ সাল থেকে দুই দেশের মধ্যে একটি এক্সপার্ট লেভেলের কমিটি বিদ্যমান রয়েছে। কিন্তু ডোকলাম ও লাদাখ সংঘর্ষের পর থেকে চীন বিভিন্ন সময়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য শেয়ার করার বিষয়ে টালবাহানা শুরু করেছে। এমতাবস্থায় ব্রহ্মপুত্রের উপর চীনের এই মেগা বাঁধ ভবিষ্যতে কোন ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতির দিকে মোড় নেয়, তা সময়ই বলবে।