‘করোনা জিহাদ’-এর মিথ্যা অভিযোগ খারিজ, তবলিঘি জামাত মামলায় হাইকোর্টের যুগান্তকারী রায়, কাঠগড়ায় রাষ্ট্রীয় প্রপাগান্ডা ও মিডিয়া

নয়াদিল্লি, ১৭ই জুলাই ২০২৫: ২০২০ সালের কোভিড-১৯ অতিমারির সূচনালগ্নে দিল্লির নিজামুদ্দিন মারকাজে অনুষ্ঠিত তবলিঘি জামাতের জমায়েতকে ঘিরে দেশজুড়ে যে ‘সুপার স্প্রেডার’ বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছিল, সেই মামলায় দিল্লী হাইকোর্টের এক যুগান্তকারী রায় এল। গতকাল (১৭ই জুলাই) বিচারপতি নীনা বানসল কৃষ্ণের একক বেঞ্চ ৭০ জন ভারতীয়র বিরুদ্ধে দায়ের করা ১৬টি এফআইআরের ‘চার্জশিট বাতিল’ করে দিয়েছেন। এই রায়ে আদালত স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, বিদেশি তবলিঘি সদস্যদের আশ্রয় দেওয়া কোনো অপরাধ ছিল না এবং তাতে কোভিড বিধি ভঙ্গের অভিযোগও প্রতিষ্ঠিত হয়নি।

‘ধর্মীয় উন্মত্ততা’ ও পরিকল্পিত বিদ্বেষের পর্দাফাঁস:

এই রায় আবারও ২০২০ সালের সেই ‘ধর্মীয় উন্মত্ততা’ এবং রাষ্ট্রীয় প্রপাগান্ডার এক জ্বলন্ত দৃষ্টান্তকে সামনে নিয়ে এসেছে। কোভিড অতিমারির শুরুতে সরকার, প্রশাসন এবং একাংশের মিডিয়া সম্মিলিতভাবে তবলিঘি জামাতের এই ধর্মীয় জমায়েতকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ‘সুপার স্প্রেডার’ বলে চিহ্নিত করে। ‘করোনা জেহাদ’, ‘বায়ো জেহাদি’, ‘মারকাজ ভাইরাস’ প্রভৃতি ঘৃণাপূর্ণ শব্দ সোশ্যাল মিডিয়ায় এবং মূলধারার সংবাদমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছিল, যা সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে একপ্রকার সামাজিক গণপিটুনির জন্ম দেয়।

আসামিপক্ষ আদালতে যুক্তি দিয়েছিল যে, যে বিদেশি নাগরিকরা মসজিদে বা বাসায় ছিলেন, তাঁরা নিরুপায় অবস্থায় সেখানে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। হঠাৎ করে লকডাউন ঘোষণা হওয়ায় তাঁদের আর কোথাও যাওয়ার উপায় ছিল না। আদালতও শুনানিতে পুলিশের কাছে প্রশ্ন রেখেছিল – এমন পরিস্থিতিতে ওই মানুষদের জন্য বিকল্প কী ছিল?

রাষ্ট্রীয় পক্ষপাতদুষ্টতা এবং মিডিয়ার ভূমিকা:

ট্রায়াল কোর্ট অনেক ক্ষেত্রে ‘ডাবল জিওপার্ডি’-র যুক্তিতে চার্জশিট গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছিল। মানবাধিকার সংগঠনগুলির মতে, যখন রাষ্ট্র অন্যান্য ধর্মীয় জমায়েত বা রাজনৈতিক সমাবেশের বিরুদ্ধে নীরব থেকেছে, তখন শুধুমাত্র একটি মুসলিম জমায়েতকে নিশানা করা ছিল রাষ্ট্রীয় পক্ষপাতদুষ্টতার ইঙ্গিত। মূলধারার একাধিক সংবাদমাধ্যমও এই বিদ্বেষ প্রচারে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিল, যা তাদের পেশাদারিত্ব নিয়েও প্রশ্ন তোলে।

গণতন্ত্রের সামনে আত্মসমালোচনার প্রশ্ন:

দিল্লী হাইকোর্টের এই রায় শুধুমাত্র ৭০ জন নিরপরাধ ভারতীয়র আইনি জটিলতা থেকে মুক্তির ঘোষণা নয়, এটি একটি বিশেষ রাজনৈতিক সময়ের ন্যায়বিচার। এই রায়ের মাধ্যমে আদালত স্মরণ করিয়ে দিল যে, ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে দোষারোপ করা এবং রাজনৈতিক প্রচারের স্বার্থে একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে নিশানা করা নৈতিক ও সাংবিধানিকভাবে গ্রহণযোগ্য নয়।

এই রায় আমাদের একটি বড় প্রশ্নের মুখে দাঁড় করায় – আমরা কি আসলেই এক ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্র হিসেবে আচরণ করতে পারছি? কোভিডের মতো বৈশ্বিক মহামারিকেও কি আমরা সাম্প্রদায়িক ঘৃণার হাতিয়ার করে তুলেছি? এবং আজ, যখন আদালত এই সমস্ত মামলাকে ভিত্তিহীন বলে বাতিল করে দিল, তখন আমাদের সমাজ, প্রশাসন এবং মিডিয়ার কাছে আত্মসমালোচনার প্রয়োজনীয়তা আরও বেশি করে সামনে উঠে এল। এটি ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ মূল্যবোধ এবং সাংবিধানিক নীতির প্রতি এক গুরুত্বপূর্ণ পুনর্বিবেচনার আহ্বান।