বর্ষায় ভাসছে বাংলা, DVC-কে দুষলেন মুখ্যমন্ত্রী, কেন্দ্রের বিরুদ্ধে বঞ্চনার অভিযোগ!

বর্ষা এখনও পুরোপুরি বিদায় নেয়নি, কিন্তু তার আগেই পশ্চিমবঙ্গের বিস্তীর্ণ এলাকা জলমগ্ন। ঘাটাল, খানাকুল, কেশপুর, জয়রামবাটি, কামারপুকুর, মেদিনীপুর শহর এবং ঝাড়গ্রামের কিছু অংশ সহ একাধিক ব্লক এখন জলের তলায়। এই ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সোমবার এক উচ্চপর্যায়ের প্রশাসনিক বৈঠকে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন এবং একগুচ্ছ কড়া নির্দেশ জারি করেন। তার বক্তব্যের মূল ফোকাস ছিল দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশন (DVC) এবং কেন্দ্রের বিরুদ্ধে লাগাতার বঞ্চনার অভিযোগ।
DVC-র অব্যবস্থাপনা: মুখ্যমন্ত্রীর ক্ষোভের আগুন
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় DVC-র ভূমিকা নিয়ে তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, “১৮ জুন থেকে আজ পর্যন্ত প্রায় ২৭ হাজার লক্ষ কিউসেক জল ছাড়া হয়েছে, কোনো আলোচনা ছাড়াই। জল ছেড়ে দিয়ে নিজেদের বাঁচাচ্ছে, বাংলার মানুষ জলবন্দি হয়ে মরছে।” তিনি অভিযোগ করেন, বারবার DVC-র জল ছাড়ার কারণেই জেলাগুলি প্লাবিত হচ্ছে, অথচ এই বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েও কোনো ফল হয়নি। DVC-র বিরুদ্ধে নজরদারির অভাব এবং দায়বদ্ধতার অভাবের অভিযোগও তোলেন তিনি।
কেন্দ্রের বিরুদ্ধে ‘বঞ্চনা’র অভিযোগ
মুখ্যমন্ত্রী স্পষ্ট ভাষায় কেন্দ্রকে কাঠগড়ায় তুলে বলেন, “আসাম পেল, বাংলা পেল না। জল ঢেলে দিয়ে বাংলা যেন দায় মুক্ত! ভোটের সময় সব হয়, জনসেবার সময় কিছু নয়।” বন্যা মোকাবিলায় রাজ্যকে কেন্দ্রের পক্ষ থেকে বঞ্চনা করা হচ্ছে বলেও তিনি অভিযোগ করেন, যা রাজ্য-কেন্দ্র সম্পর্কের টানাপোড়েনকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
ঘাটাল মাস্টারপ্ল্যান: দুই বছরের মধ্যে সমাধানের আশ্বাস
যদিও এই মুহূর্তে রাজ্যের একাধিক জেলা জলের তলায়, মুখ্যমন্ত্রী ঘাটালে একটি স্থায়ী সমাধানের আশ্বাস দিয়েছেন। তিনি বলেন, “ঘাটাল মাস্টারপ্ল্যানের কাজ চলছে। আমি আশা করছি, আগামী দু’বছরের মধ্যে এটা পুরোপুরি শেষ হয়ে যাবে। তাহলেই ওই অঞ্চলের মানুষদের বারবার জলে ডুবে থাকার দুর্ভোগ কমবে।” এই প্রকল্প শেষ হলে ঘাটাল এবং তার পার্শ্ববর্তী এলাকার মানুষ জলবন্দি অবস্থা থেকে মুক্তি পাবেন বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
প্রশাসনিক তৎপরতা: একগুচ্ছ নির্দেশ
বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় মুখ্যমন্ত্রী একাধিক গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশ দিয়েছেন:
জেলাগুলিতে সচিব নিয়োগ: মুখ্যসচিবকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, বন্যা কবলিত প্রত্যেক জেলায় তিনজন করে প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি বা সচিবকে আগামী সাতদিনের জন্য পাঠানো হোক, যতদিন না পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়।
পুলিশকে ডেভেলপমেন্ট প্ল্যান: জল জমা রুখতে পুলিশকে এলাকা অনুযায়ী ডেভেলপমেন্ট প্ল্যান তৈরি করতে বলা হয়েছে।
উত্তরবঙ্গে নজরদারি: উত্তরবঙ্গেও কোথায় কতক্ষণে জল জমে তা নজরে রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে জেলা প্রশাসনকে।
কৃষকদের আশ্বাস: ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের আশ্বস্ত করে মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, “আপনারা চিন্তা করবেন না, জমি জলের তলায় গেলেও আপনারা বিমার টাকা পাবেন।” তিনি ধান উৎপাদনে বাংলার সাফল্যের কথা তুলে ধরে জানান, এর জন্য রাজ্য সরকার প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা খরচ করে।
গ্রামীণ সড়কে নজরদারি: গ্রামীণ রাস্তা দিয়ে ভারী গাড়ি প্রবেশ যেন না হয়, সে বিষয়ে পঞ্চায়েত দফতরকে কড়া হাতে দেখতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। স্থানীয় স্তরের স্বার্থে কেউ রাস্তা ব্যবহার করলে তার বিরুদ্ধে পদক্ষেপের কথা বলেন তিনি।
জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয়: মন্ত্রী ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের ২১শে জুলাই পর্যন্ত কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও, সেই সময়ের মধ্যেও সমন্বয় করে কাজ করার বার্তা দেন। তিনি ‘কে বেশি পেল, কে কম’ – এই মনোভাব পরিহার করে সবাইকে মিলেমিশে কাজ করার আহ্বান জানান।
বনায়ন: ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, জল নেমে যাওয়ার পর উপযুক্ত জায়গাগুলোতে ব্যাপকভাবে গাছ লাগানোর উদ্যোগ নেওয়া হোক।
একের পর এক নির্দেশ এবং কেন্দ্রের বিরুদ্ধে মুখ্যমন্ত্রীর এই কড়া অবস্থান, রাজ্যের বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রশাসনের সর্বোচ্চ তৎপরতাকে তুলে ধরছে। এখন দেখার বিষয়, এই পদক্ষেপগুলি কতটা কার্যকর হয় এবং কবে রাজ্যের জলমগ্ন এলাকাগুলি স্বাভাবিক ছন্দে ফেরে।