পকসো মামলায় দ্রুত ন্যায়বিচার জলপাইগুড়িতে, দেড় বছরে ৩১টি রায়ের পেছনে সমন্বিত প্রচেষ্টা

চা-বাগান অধ্যুষিত জলপাইগুড়ি জেলায় নাবালক-নাবালিকাদের উপর যৌন নির্যাতনের ঘটনায় দায়ের হওয়া পকসো (Protection of Children from Sexual Offences) মামলাগুলোর নিষ্পত্তিতে অভূতপূর্ব গতি এসেছে। গত দেড় বছরে জলপাইগুড়ি জেলা পুলিশ এলাকায় মোট ৩১টি পকসো মামলার রায় ঘোষণা হয়েছে, যা জেলা আদালতের ইতিহাসে এক নতুন মাইলফলক। এর মধ্যে ২০২৪ সালে ১৬টি এবং চলতি বছরে এখনও পর্যন্ত ১৫টি মামলায় সাজা ঘোষণা করা হয়েছে। সম্প্রতি এক কিশোরীকে ধর্ষণ ও খুনের দায়ে তিনজনের ফাঁসির সাজা ঘোষণা এর সর্বশেষ দৃষ্টান্ত।
দ্রুত নিষ্পত্তির নেপথ্যে কী?
পুলিশ-প্রশাসন থেকে শুরু করে আইনজীবী এবং মনোবিদদের সঙ্গে কথা বলে জানা যাচ্ছে, এই দ্রুত নিষ্পত্তির পেছনে রয়েছে একাধিক কারণ এবং সমন্বিত প্রচেষ্টা।
সচেতনতা বৃদ্ধি: মানুষের মধ্যে পকসো সংক্রান্ত অভিযোগ জানানোর বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে। আগে যা লোকলজ্জা বা সামাজিক ভয়ে চাপা পড়ে যেত, এখন তা প্রকাশ্যে আসছে।
দ্রুত তদন্ত ও চার্জশিট: পুলিশ পকসো মামলাগুলোর তদন্ত অত্যন্ত দ্রুত গতিতে শেষ করে নির্দিষ্ট ৬০ দিনের মধ্যে চার্জশিট জমা দিচ্ছে।
সরকারি আইনজীবীদের ভূমিকা: সরকারি আইনজীবীরাও আদালতে অত্যন্ত ইতিবাচক এবং সক্রিয় ভূমিকা পালন করছেন, যার ফলে মামলার ট্রায়াল দ্রুত এগোচ্ছে।
বিচারকের সক্রিয়তা: জলপাইগুড়ি পকসো আদালতের বিচারক রিন্টু সূর গত কয়েক মাসেই প্রচুর পকসো মামলায় সাজা ঘোষণা করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।
জলপাইগুড়ির পুলিশ সুপার খাণ্ডবহালে উমেশ গণপত এই বিষয়ে বলেন, “শাস্তির প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। এর ফলে একটি বার্তা যাবে। তাছাড়া ৬০ দিনের মধ্যে চার্জশিট দেওয়ার নিয়ম রয়েছে। তাই পুলিশের কাজ দ্রুতগতিতে তদন্ত করে চার্জশিট দিয়ে ট্রায়াল শেষ করা। সরকারি আইনজীবীরা ও বিচারক দ্রুতগতিতে ট্রায়াল শেষ করছেন। তার ফলও হাতেনাতে পাওয়া যাচ্ছে।”
উদ্বেগের দিক: পরিচিতদের দ্বারা নির্যাতন
পুলিশ আধিকারিকরা জানাচ্ছেন, অনেক ক্ষেত্রেই পরিচিত, আত্মীয় বা প্রতিবেশীদের দ্বারা ছোট ছোট মেয়েরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। কখনও প্রতিবেশী যুবক, কখনও আত্মীয়তার সম্পর্কে থাকা দাদা-কাকা-জেঠু-দাদুরা এই ধরনের অপরাধ ঘটাচ্ছে। এমনকি, অনেক সময় বাড়ির মধ্যেও নিকট পরিজনের দ্বারাও নাবালিকারা অত্যাচারের শিকার হচ্ছে, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক।
ছোট শিশুদের ক্ষেত্রে খাবার বা অন্য কিছুর প্রলোভন দেখিয়ে ঘটনা ঘটানো হচ্ছে।
কিশোরীদের ক্ষেত্রে বন্ধু বা প্রেমিকরাই মূল অপরাধী হিসেবে উঠে আসছে।
অনেক সময় নির্যাতনের পর খুনও করে দেওয়া হচ্ছে, যা সমাজের জন্য অশনি সংকেত।
মনোবিদ মৌসুমী কুণ্ডু বলেন, “পকসো কেস খুব বেশি আসছে। প্রতিনিয়ত ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। অনেকেই থানায় আসছে না। আমি কাউন্সেলিং করার সময় দেখা যাচ্ছে বাড়ির আত্মীয়দের দ্বারা ঘটনাটি ঘটছে। ছোটবেলার ঘটনা কিন্তু বড় হয়ে যাওয়ার পরেও ট্রমা হিসেবে ফিরে আসছে। এখন সচেতনতা বৃদ্ধির ফলে অনেক ঘটনা সামনে আসছে।”
সচেতনতা বৃদ্ধিতে জোর: আগামীর পথ
পুলিশ-প্রশাসনের তরফে মানুষকে আরও বেশি সচেতন করতে জোরদার প্রচার চালানো হচ্ছে। পাড়ায় পুলিশ কর্মসূচির মাধ্যমে চা-বাগান এবং গ্রামগুলোতে সচেতনতা বৃদ্ধি করা হচ্ছে। পুলিশ সুপারের আবেদন, “কোনও ঘটনা ঘটলেই পুলিশকে জানান।” তিনি জানান, এখন মানুষ কোনও ঘটনা ঘটলে থানায় আসছে এবং পকসো মামলার সংখ্যাও বেড়েছে।
মহিলা ও শিশু সুরক্ষায় এই বছর উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করায় জলপাইগুড়ি জেলা পুলিশের একাধিক থানাকে পুরস্কৃত করা হয়েছে। পুলিশ সুপার বলেন, “আমরা সেই সকল তদন্তকারী অফিসারদের উৎসাহিত করার জন্যই সম্মান প্রদান করছি, যাতে তাঁরা কাজে উৎসাহিত হন। আমরা প্রত্যেক থানা এলাকায় সচেতনতা বৃদ্ধি করছি, কোনও নাবালিকার সঙ্গে কোনও অপরাধমূলক কাজ হলে, সেটি যাতে লুকানো না-হয়, সেই প্রচারও চলছে। তৎক্ষণাৎ পুলিশকে খবর দেওয়ার কথা আমরা বলছি।”
সরকারি আইনজীবী দেবাশিস দত্তও মনে করেন, সাজার বার্তা সমাজে গেলে দুষ্কৃতীরা সাবধান হবে। তিনি বলেন, “এখন মানুষ বিচার চাইছে। আগে সমাজের ভয়ে অনেকে সামনে এগিয়ে আসত না।”
সমাজসেবী রাজু নেপালি বলেন, “সচেতনতা বৃদ্ধির ফলে এই ধরনের অপরাধগুলো আর ধামাচাপা পড়ছে না। আগে সচেতনতার অভাবে অনেক মামলা ধামাচাপা পড়ত।” তিনি পুলিশের ভূমিকার প্রশংসা করেন এবং বলেন, “আমরাও পুলিশের সঙ্গে বিভিন্ন স্কুল-কলেজে, চা-বাগানে সচেতনতা বৃদ্ধি করছি, যার ফলে বাচ্চারাও যেমন বাবা-মাকে সব খুলে বলছে, তেমনই অভিভাবকরাও এগিয়ে এসে পুলিশের সাহায্য নিচ্ছে।”
সব মিলিয়ে, জলপাইগুড়িতে পকসো মামলাগুলোর দ্রুত নিষ্পত্তি এবং কঠোর সাজার মাধ্যমে সমাজ থেকে এই ঘৃণ্য অপরাধ নির্মূল করার একটি ইতিবাচক বার্তা দেওয়া হচ্ছে।