কলেজ ক্যাম্পাসে ‘দাদা’দের বাড়বাড়ন্তই কি ‘নিউ নর্মাল’? কি বলছেন সমাজের বিশিষ্টরা

ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে ক্যান্টিনে আড্ডা, বিতর্ক, প্রফেসরদের লেকচার, বন্ধুত্ব, প্রেম—ক্যাম্পাস জীবনের এই চিরাচরিত ছবি কি ধীরে ধীরে অতীত হয়ে যাচ্ছে? গত বছর আরজি কর, এ বছর কসবা এবং আইআইএম জোকার ক্যাম্পাসে নারী নির্যাতনের অভিযোগ, বালুরঘাটে কলেজের ভিতরে ‘ইউনিয়নের দাদা’র মদের গ্লাসে চুমুক দেওয়ার ভাইরাল ভিডিও, সোনারপুর কলেজে ইউনিয়ন রুমে প্রথম বর্ষের ছাত্রীকে দিয়ে মাথা টেপানোর বিতর্কিত দৃশ্যের পর স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে: শিক্ষাঙ্গনের ‘ক্যাম্পাস কালচার’-এ ‘রাউডি টাচ’টাই কি এখন ‘নিউ নর্মাল’? শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অন্দরে কেন বারবার আইনভঙ্গের অভিযোগ উঠছে? এই সময় অনলাইন এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে বিশিষ্টজনদের মতামত নিয়েছে।
সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়: নৈতিক অধঃপতন এবং আত্মশাসনের অভাব
ক্যাম্পাসের ‘হাওয়া বদল’-এর জন্য নৈতিক অধঃপতনকে দুষছেন প্রখ্যাত সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। তিনি মনে করেন, মানুষের মধ্যে ‘আত্মশাসনের’ অভাব প্রকট হচ্ছে। তাঁর কথায়, “একটা নৈতিক ডিজিটালাইজেশন হয়েছে। নৈতিক অধোগতি দেখতে পাচ্ছি। মানুষের মধ্যে আত্মশাসন থাকাটা খুব প্রয়োজন। এখন সেই সংযমের শিক্ষাটা একদম নেই। মেধা হয়তো বাড়ছে। কিন্তু শুধু মেধা বাড়লেই হবে না। নৈতিক শিক্ষাও সমান তালে নিতে হবে। মানুষের মধ্যে নীতিবোধ কমে গিয়েছে।” তিনি পারিবারিক শিক্ষার উপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলেছেন। তাঁর বার্তা, মানুষের মধ্যে থাকা শয়তানকে জিততে দেওয়া যাবে না, ভালোর ভাগটাই যেন অধিক থাকে, সেদিকে নজর দিতে হবে।
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় আরও বলেন:
নৈতিক শিক্ষা সমান তালে নিতে হবে।
নিয়ম কানুন ও সংযমের শিক্ষা নেই, মানাও হয় না।
দুষ্কৃতী আগেও ছিল, তবে কম ছিল। আগে এমন কিছু ঘটলে অবাক হতাম, এখন আর হই না। বিষয়টা জলভাতের মতো হয়ে গিয়েছে।
বয়সে কম মানুষের মধ্যে শয়তানও রয়েছে, দেবত্বও রয়েছে। শয়তানকে জিততে দেওয়া যাবে না।
শিক্ষাবিদ পবিত্র সরকার: রাজনৈতিক পরিবেশ ও ছাত্র ইউনিয়ন বন্ধের প্রভাব
অন্যদিকে, ক্যাম্পাস চত্বরে অপরাধের ঘটনা বৃদ্ধির জন্য রাজনৈতিক পরিবেশকে দুষেছেন শিক্ষাবিদ পবিত্র সরকার। ছাত্র ভোট না হওয়া নিয়েও তিনি সরব হয়েছেন। পবিত্র সরকার বলেন, “সর্বত্র ভুতুড়ে ইউনিয়ন তৈরি করে মদ্যপান বা মেয়েদের হেনস্থার বিষয়গুলি এই সরকারের আমল থেকে তৈরি হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে ধর্ষণের ঘটনায় দোষীরা শাস্তি পাচ্ছে না। ছাত্রছাত্রীদের নৈতিক মেরুদণ্ড নষ্ট করা হচ্ছে।” তবে, তিনি আশাবাদী যে ‘ভোরের আলো ফুটবে’। পবিত্র সরকার বলেন, “দীর্ঘজীবন পেয়েছি বলে এ সব দেখতে হচ্ছে। আফসোস হচ্ছে। ভাবি হয়তো নতুন প্রজন্ম আসবে এবং বদল আনবে। আশা ছাড়ি না, কিন্তু কষ্ট নিয়ে বাঁচছি।”
পবিত্র সরকার আরও যা বললেন:
২০১৭ সাল থেকে ছাত্র ইউনিয়ন বন্ধ করা হয়েছে। আমরা সর্বস্তরে ছাত্র ইউনিয়ন করে এসেছি। কিন্তু বেলেল্লাপনার জায়গা ছিল না।
গুছিয়ে ছাত্রছাত্রীদের নৈতিক মেরুদণ্ড নষ্ট করা হচ্ছে।
একদল বুদ্ধিজীবী নৈতিক মেরুদণ্ড নষ্ট করেছেন।
বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য শিবাজীপ্রতিম বসু: শুধুমাত্র ‘ইউনিয়ন কেন্দ্রিক ছাত্র রাজনীতি’ ও ‘নৈতিক স্খলন’
বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য শিবাজীপ্রতিম বসু শুধুমাত্র ‘ইউনিয়ন কেন্দ্রিক ছাত্র রাজনীতি’ এবং ‘নৈতিক স্খলন’কেই ক্যাম্পাসে অপরাধ প্রবণতার বাড়বাড়ন্তের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তিনি বলেন, “বাংলায় ছাত্র রাজনীতির ইতিহাস দীর্ঘদিনের। তার একটা আদর্শ ছিল। কিন্তু দেশ এবং সমাজের বিভিন্ন অন্যায়ের বিরুদ্ধে ছাত্রদের আন্দোলন যখন স্তিমিত হয়ে যায়, তখন শুধুমাত্র ইউনিয়ন দখলের জায়গাতেই থাকে ছাত্র রাজনীতি। তা সমস্ত দলের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। সে ক্ষেত্রে দেশ বা সমাজকে তাঁদের কিছু দেওয়ার থাকে না। ছাত্ররা সবাই খারাপ হয়ে যায়নি।” তাঁর দাবি, শুধুমাত্র ইউনিয়ন কেন্দ্রিক রাজনীতি, নৈতিক স্খলন, আদর্শের অভাব ক্যাম্পাসগুলিতে অপরাধের ঘটনা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ।
শিবাজীপ্রতিম বসু আরও বলেন:
দেশ গঠন, সমাজের বিভিন্ন অন্যায়ের বিরুদ্ধে ছাত্রদের আন্দোলন যখন স্তিমিত হয়ে যায়, তখন কেবল ইউনিয়ন দখলের জায়গায় পৌঁছায় ছাত্র রাজনীতি।
বিশিষ্টজনদের এই মতামতগুলি শিক্ষাঙ্গনে ক্রমবর্ধমান অপরাধ প্রবণতা এবং পরিবর্তিত ক্যাম্পাস সংস্কৃতির উপর গভীর আলোকপাত করছে। নৈতিকতা, আত্মশাসন এবং ছাত্র রাজনীতির ভূমিকা—এই তিনটি বিষয়ই বর্তমান পরিস্থিতির মূল কারণ হিসেবে উঠে এসেছে। এই উদ্বেগজনক পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের পথ খোঁজা এখন সময়ের দাবি।
তথ্যসূত্র: এই সময়