পঞ্চায়েতে কড়াকড়ি নবান্নের, নিজস্ব আয় বৃদ্ধি ও ৫০% জনস্বার্থে ব্যয়ের নতুন শর্ত, জুলাই থেকেই মূল্যায়ন শুরু

গ্রামোন্নয়ন ও আর্থিক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে রাজ্যের পঞ্চায়েতগুলির বার্ষিক মূল্যায়ন প্রক্রিয়ায় বড়সড় পরিবর্তন আনল রাজ্য সরকার। ২০২৪-২৫ অর্থবর্ষ থেকে কার্যকর হতে চলা এই নতুন নীতিতে, পূর্বের ১৭টি শর্তের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে আরও ১০টি নতুন কঠিন শর্ত। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি শর্ত হলো— পঞ্চায়েতের মোট নিজস্ব আয়ের অন্তত ৫০ শতাংশ জনস্বার্থে ব্যয় করতে হবে এবং আগের অর্থবর্ষের তুলনায় অন্তত ১০ শতাংশ রাজস্ব বৃদ্ধি নিশ্চিত করতে হবে। জুলাই মাস থেকেই এই পরিবর্তিত মূল্যায়ন প্রক্রিয়া শুরু হচ্ছে।

অনুদান বন্ধের হুঁশিয়ারি, দায়বদ্ধতা বৃদ্ধিতে জোর

নবান্ন সূত্রে জানা গেছে, এই নতুন নির্দেশিকায় পঞ্চায়েতগুলিকে স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, যদি তারা উন্নয়ন এবং জনকল্যাণমূলক কাজে অর্থ ব্যয় না করে, তাহলে পারফরম্যান্স গ্রান্ট সহ অন্যান্য সরকারি অনুদান বন্ধ করে দেওয়া হবে। রাজ্যের পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন দফতর মনে করছে, এই কঠোর পদক্ষেপের ফলে পঞ্চায়েতগুলির মধ্যে দায়বদ্ধতা যেমন বৃদ্ধি পাবে, তেমনি বিকেন্দ্রীভূত উন্নয়নের গতি আরও বাড়বে।

পঞ্চায়েতমন্ত্রী প্রদীপ মজুমদার এই প্রসঙ্গে বলেন, “মানুষের কাছে পরিষেবা পৌঁছে দেওয়াই সরকারের প্রধান অগ্রাধিকার। কেন্দ্র যে সমস্ত প্রকল্পের অর্থ বন্ধ করেছে, তার অনেকটাই রাজ্য নিজস্ব তহবিল থেকে চালাচ্ছে। তাই আমরা চাই, পঞ্চায়েতগুলি নিজেদের আয় বৃদ্ধি করুক এবং তা জনস্বার্থে খরচ করুক। তবেই গ্রামের মানুষ উন্নয়নের সরাসরি সুফল পাবেন।”

নতুন শর্তাবলির মূল দিকগুলি

নতুন সংযোজিত ১০টি শর্তের মধ্যে কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক নিম্নরূপ:

নিজস্ব আয়ের অর্ধেক জনকল্যাণে ব্যয়: পঞ্চায়েতকে তার মোট নিজস্ব আয়ের অন্তত ৫০ শতাংশ সরাসরি জনকল্যাণমূলক কাজে ব্যয় করতে হবে।

আয় বৃদ্ধিতে গুরুত্ব: আগের বছরের তুলনায় নিজস্ব রাজস্ব আয় অন্তত ১০ শতাংশ বৃদ্ধি করতে হবে।

স্বচ্ছতা ও ডিজিটালীকরণ: পঞ্চায়েতের পরিষেবা প্রদান ব্যবস্থায় সম্পূর্ণ স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে এবং সমস্ত রেকর্ড ডিজিটালভাবে সংরক্ষণ ও নিয়মিত আপডেট রাখতে হবে।

গ্রামবাসীর অংশগ্রহণ: পরিষেবা ও বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে গ্রামবাসীর সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।

এই কঠোর শর্তগুলি পালনের ভিত্তিতেই নির্ধারিত হবে কোন পঞ্চায়েত সরকারি অনুদান পাবে আর কোনটি পাবে না।

কেন এই কড়া পদক্ষেপ?

প্রশাসনিক বিশেষজ্ঞদের মতে, বহু পঞ্চায়েত এখনো পর্যন্ত নিজস্ব রাজস্ব বৃদ্ধির ক্ষেত্রে যথেষ্ট উদ্যোগী নয়। আবার অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, আয়কৃত অর্থ জনস্বার্থে ব্যয় না করে প্রশাসনিক খাতে বা অন্যান্য অপ্রয়োজনীয় খাতে খরচ করা হচ্ছে। এর ফলে গ্রামের প্রাথমিক পরিষেবা যেমন পানীয় জল, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, রাস্তা নির্মাণ ইত্যাদি প্রকল্পে প্রত্যাশিত উন্নয়ন ঘটছে না। এই সমস্যাগুলি মোকাবিলা করতেই নবান্ন নতুনভাবে শর্তাবলিকে আরও কঠোর করেছে।

সরকারের প্রত্যাশা

রাজ্য সরকারের আশা, এই নতুন মূল্যায়ন নীতি সফলভাবে বাস্তবায়িত হলে:

পঞ্চায়েতগুলির মধ্যে ইতিবাচক প্রতিযোগিতা তৈরি হবে।

তারা নিজস্ব আয় বাড়ানোর দিকে আরও বেশি গুরুত্ব দেবে।

জনসেবার মান এবং স্বচ্ছতা বৃদ্ধি পাবে।

গ্রামীণ মানুষের কাছে উন্নয়নের সরাসরি সুফল পৌঁছাবে।

অর্থাৎ, এই পদক্ষেপে পঞ্চায়েত স্তরের আর্থিক শৃঙ্খলা এবং জনকল্যাণ— উভয় দিকেই সরকার সুনির্দিষ্ট নজর দিচ্ছে। প্রশাসনিক মহল মনে করছে, এই মডেল সফল হলে ভবিষ্যতে অন্যান্য রাজ্যও পশ্চিমবঙ্গের এই উদ্যোগ অনুসরণ করতে পারে।