প্রতি ঘণ্টায় ১০০ প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে এই রোগ, WHO-এর ভয়ঙ্কর রিপোর্ট

কোভিড-১৯ এর ভয়াবহতা যখন বিশ্ব দেখেছিল, তখন এক অদৃশ্য ভাইরাসের দাপটে লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু আতঙ্ক ছড়িয়েছিল। হৃদরোগ, ডায়াবেটিস সহ বিভিন্ন শারীরিক অসুস্থতাও প্রতিদিন কেড়ে নিচ্ছে অগণিত প্রাণ। কিন্তু এবার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)-এর সাম্প্রতিক প্রতিবেদন “From Loneliness to Social Connection” এক নতুন এবং আরও ভয়াবহ বাস্তবকে উন্মোচন করেছে। এই রিপোর্ট অনুযায়ী, একাকীত্ব এমন এক বিপজ্জনক ব্যাধি, যা বিশ্বজুড়ে প্রতি ঘণ্টায় ১০০ জন মানুষের জীবন কেড়ে নিচ্ছে – একটি সংখ্যা যা অনেক প্রচলিত রোগের মৃত্যুর হারকেও ছাপিয়ে যেতে পারে।

কেবল মানসিক নয়, শারীরিক স্বাস্থ্যও ঝুঁকির মুখে

WHO-এর প্রতিবেদনে পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, একাকীত্ব কেবল মানসিক স্বাস্থ্যের উপরই নেতিবাচক প্রভাব ফেলে না, বরং শরীরের উপরও এর মারাত্মক কুপ্রভাব রয়েছে। এই নীরব ঘাতক হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, স্ট্রোক এবং অকাল মৃত্যুর ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়িয়ে তোলে। নতুন গবেষণা বলছে, কোভিড-১৯ মহামারীর পর থেকে এই সমস্যা আরও প্রকট আকার ধারণ করেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গবেষণায় বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে এবং শহরাঞ্চলে বসবাসকারী মানুষের মধ্যে একাকীত্বের ক্রমবর্ধমান প্রবণতা ধরা পড়েছে।

ভারতে একাকীত্বের উদ্বেগজনক চিত্র: শহর ও তরুণরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত
জার্নাল অফ ফ্যামিলি মেডিসিন অ্যান্ড প্রাইমারি কেয়ারে প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্র অনুযায়ী, করোনা অতিমারীর সময় ভারতে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে। শহরাঞ্চলে এই সংখ্যা আরও উদ্বেগজনক – প্রায় ২২% মানুষ একাকীত্ব অনুভব করছেন। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ১৬-২৪ বছর বয়সী যুবকদের মধ্যে ৪০% একাকীত্বে ভুগছেন, যা ৬৫ থেকে ৭৪ বছর বয়সী ২৯% মানুষের একাকীত্বের যন্ত্রণাকেও ছাড়িয়ে গেছে।

ভারতে একাকীত্বের সমস্যা যথেষ্ট গুরুতর। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের প্রায় ১০.১% মানুষ একাকীত্বের সঙ্গে লড়াই করছেন, এবং শহরাঞ্চলে এই হার অনেক বেশি। গবেষকরা মনে করছেন, কোভিড-১৯ পরবর্তী সময়ে সামাজিক দূরত্ব এবং ডিজিটাল সংযোগের উপর অতিরিক্ত নির্ভরতা এই একাকীত্বের যন্ত্রণাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ছোট পরিবার, দ্রুত নগরায়ন এবং আধুনিক জীবনের ব্যস্ততা এই সমস্যাকে আরও জটিল করে তুলছে। বিশেষ করে দিল্লি, মুম্বাই এবং বেঙ্গালুরুর মতো মেট্রো শহরগুলিতে তরুণদের মধ্যে মানসিক চাপ এবং একাকীত্বের সমস্যা আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে।

একাকীত্বের বহুমুখী স্বাস্থ্য ঝুঁকি ও প্রতিরোধের পথ
WHO-এর মতে, একাকীত্ব হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস এবং স্ট্রোকের ঝুঁকি বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। এর পাশাপাশি, এটি স্মৃতিশক্তি হ্রাস, ডিমেনশিয়া এবং আলঝাইমারের মতো স্নায়বিক রোগের সঙ্গেও যুক্ত। মানসিক স্বাস্থ্যের উপর এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী, যার ফলে হতাশা, উদ্বেগ এবং আত্মহত্যার ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়। একাকীত্বের সঙ্গে সংগ্রাম করা ব্যক্তিরা শারীরিক এবং মানসিক উভয় স্তরেই দুর্বল হয়ে পড়ে।

দিল্লি এইমসের চিকিৎসক ডাঃ সঞ্জয় রাই এই নীরব মহামারী থেকে মুক্তির পথ বাতলে দিয়েছেন। তিনি জোর দিয়ে বলেছেন, একাকীত্ব কমাতে নিয়মিত শারীরিক কার্যকলাপ এবং সামাজিক যোগাযোগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ঘরের ভেতরে নিজেকে আবদ্ধ না রেখে পার্কে হাঁটা বা বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে দেখা করা স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী হতে পারে। একই সাথে, তিনি তরুণদের স্ক্রিন টাইম কমিয়ে অফলাইন কার্যকলাপে অংশগ্রহণে উৎসাহিত করেছেন। বিশেষজ্ঞরা আরও মনে করছেন, বয়স্ক এবং যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল, তারাই একাকীত্বজনিত অসুস্থতার শিকার বেশি হন।

একাকীত্ব আর বিচ্ছিন্নতা যেন আজকের সমাজের এক লুকানো ক্ষত। এর বিরুদ্ধে সচেতনতা বাড়ানো এবং সামাজিক সংযোগ গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি। এই নীরব ঘাতককে রুখতে ব্যক্তিগত উদ্যোগের পাশাপাশি সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়েও পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি।