বিড়ালের জোরে আওয়াজ করার সম্ভাব্য কারণ কি? জেনেনিন বলছে গবেষণা?

আপনার পোষা বিড়ালটি কি খুব বেশি কথা বলে, নাকি নীরবে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করতে পছন্দ করে? কেন একই বাড়িতে একাধিক বিড়ালের মধ্যে ব্যক্তিত্বের এত ভিন্নতা দেখা যায়? এই প্রশ্নটি বহু বিড়ালপ্রেমীকে ভাবিয়েছে। সম্প্রতি জাপানের কিয়োটো বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্যপ্রাণী গবেষক ইউমে ওকামোতো এবং তার সহকর্মীদের এক গবেষণায় এই রহস্যের সমাধান হয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, বিড়ালের এই স্বভাবগত পার্থক্যের মূল কারণ হলো তাদের জিন।

জিনের প্রভাব: নীরবতা থেকে কণ্ঠস্বর

গবেষকরা জাপানের বিভিন্ন বিড়ালের মালিকদের কাছ থেকে তাদের পোষা বিড়ালের আচরণ সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করেছেন, যার মধ্যে মানুষের প্রতি ‘ঘড় ঘড়’ করা বা বিভিন্ন ‘কণ্ঠধ্বনি’ অন্তর্ভুক্ত ছিল। একইসঙ্গে বিড়ালদের মুখের লালার নমুনাও সংগ্রহ করা হয় জিনগত বিশ্লেষণের জন্য। গবেষকরা বিশেষ করে ‘এক্স’ ক্রোমোজোমে অবস্থিত বিড়ালের অ্যান্ড্রজেন রিসেপ্টর জিনের ওপর নজর দেন। এই জিনটি টেস্টোস্টেরনের মতো হরমোনের প্রতি শরীরের প্রতিক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে এবং এর একটি অংশে ডিএনএ সিকোয়েন্সের পুনরাবৃত্তি হয়।

বিবিসি-র প্রতিবেদন অনুযায়ী, অ্যান্ড্রজেন রিসেপ্টরের সবচেয়ে প্রাচীন রূপ প্রায় ৪৫ কোটি বছর আগে সব চোয়ালযুক্ত মেরুদণ্ডী প্রাণীর একটি সাধারণ পূর্বপুরুষের মধ্যে দেখা গিয়েছিল। এটি পুরুষ প্রজনন অঙ্গের গঠন, গৌণ যৌন বৈশিষ্ট্য ও প্রজনন আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে। এই ক্রমগুলির সংখ্যা জিনের প্রতিক্রিয়াশীলতার ওপর প্রভাব ফেলে। ছোট ছোট জিন সিকোয়েন্সের পুনরাবৃত্তি রিসেপ্টরকে অ্যান্ড্রজেনের প্রতি আরও সংবেদনশীল করে তোলে। মানুষ ও কুকুর-সহ অন্যান্য প্রজাতির ক্ষেত্রে অ্যান্ড্রজেন রিসেপ্টর জিনে সংক্ষিপ্ত পুনরাবৃত্তি বেশি থাকলে আগ্রাসী আচরণ ও বহির্মুখী স্বভাব দেখা যায়।

আচারণগত ভিন্নতা: জিন ভেদে বিড়ালের স্বভাব

গবেষণায় ২৮৯টি স্পে বা নিউটার করা বিড়ালের ওপর পরীক্ষা চালানো হয়। দেখা যায়, যাদের সংক্ষিপ্ত অ্যান্ড্রজেন রিসেপ্টর জিন ছিল, তারা বেশি আওয়াজ করে। এই ধরনের পুরুষ বিড়ালরা মানুষের দিকে তাকিয়ে আওয়াজ করে, যেমন খাবার চাইতে বা বাইরে যেতে চাওয়ার সময় মিউ মিউ করে। একই ধরনের জিন থাকা নারী বিড়ালরা অপরিচিতদের প্রতি বেশ আক্রমণাত্মক ছিল।

অন্যদিকে, যাদের অ্যান্ড্রজেন রিসেপ্টর জিন দীর্ঘ, সেই বিড়ালরা কম সক্রিয় এবং তুলনামূলকভাবে শান্ত থাকে। এই জিনের ভেরিয়েন্টটি পেডিগ্রি জাতের বিড়ালদের মধ্যে বেশি দেখা যায়, যাদের সহজেই বশ মানানোর জন্য প্রজনন করানো হয়।

গৃহপালনের জটিল চিত্র: বন্য স্বভাবের টিকে থাকা

সাধারণত মনে করা হয়, গৃহপালনের কারণে বিড়ালদের ডাকাডাকি বা যোগাযোগ করার প্রবণতা বেড়ে যায়। তাই এটি খানিকটা অদ্ভুত মনে হতে পারে যে, যে জিন ভেরিয়েন্টটি বেশি যোগাযোগ ও আত্মপ্রকাশের সঙ্গে যুক্ত, সেটিই আবার বন্য প্রজাতির বিড়ালের (যেমন লিনাক্স) মধ্যেও পাওয়া যায়।

এই গবেষণা বিড়ালের গৃহপালনের ইতিহাসে কোনো সহজ ব্যাখ্যা দেয় না। বরং এটি একটি জটিল চিত্র তুলে ধরে, যেখানে পূর্বপুরুষদের কিছু বৈশিষ্ট্য এখনও টিকে থাকতে পারে, যেমন আগ্রাসন—বিশেষ করে যখন ঘরোয়া পরিবেশে সম্পদের অভাব থাকে। কিছু প্রাণী মানুষের কাছাকাছি থাকে কারণ তাদের মানুষের সম্পদে লোভ থাকে। তবে মানুষের কাছাকাছি থাকলেই যে প্রাণীরা বিনয়ী হয়, তা-ও নয়। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলো শহরের গাঙচিল।

লিভারপুল জন মুরস ইউনিভার্সিটির গবেষকরা দেখেছেন, শহরের গাঙচিলরা গ্রামের গাঙচিলের তুলনায় মানুষদের কম ভয় পায় এবং এদের ঝগড়া করার প্রবণতা বেশি। এরা খাবার ছিনিয়ে নিতে অথবা পথচারীদের তাড়া দিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

পরিবেশ ও জিনের মেলবন্ধন: বিবর্তনের অপরিহার্য বৈচিত্র্য

বিড়ালের সঙ্গে গাঙচিলের এই মিল আরও বড় প্রশ্নের জন্ম দেয় যে, পরিবেশ ও জিন মিলে কীভাবে একটি প্রাণীর আচরণ গড়ে তোলে। ইউমে ওকামোতো ও তার সহকর্মীদের গবেষণার ফলাফল হয়তো একটি চিত্র তুলে ধরে: সংক্ষিপ্ত অ্যান্ড্রজেন রিসেপ্টর ভেরিয়েন্টের সঙ্গে সম্পর্কিত বৈশিষ্ট্য, যেমন বেশি উচ্চকণ্ঠ হওয়া বা আত্মপ্রকাশে সাহসী হওয়া, প্রতিযোগিতামূলক বা অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে মানুষের মনোযোগ পাওয়ার ক্ষেত্রে সুবিধা দিতে পারে।

তবে, একই বৈশিষ্ট্য আবার আগ্রাসী আচরণ হিসেবেও প্রকাশ পেতে পারে, যা ইঙ্গিত দেয় যে, গৃহপালনের ফলে বিড়ালের মাঝে কাঙ্ক্ষিত ও চ্যালেঞ্জিং উভয় ধরনের বৈশিষ্ট্যের মিশ্রণ তৈরি হয়। মনে রাখা জরুরি, এমন স্বভাবগত বৈচিত্র্যই প্রজাতির বিবর্তনের জন্য অপরিহার্য। যদি সব প্রাণীর আচরণ একরকম হতো, তবে তারা পরিবেশের পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারত না। বিড়ালের ক্ষেত্রে এর মানে হলো, কোনো একক “আদর্শ” স্বভাব হয়তো নেই, বরং বিভিন্ন ধরনের গৃহস্থালিভিত্তিক পরিস্থিতিতে টিকে থাকার জন্য নানা ধরনের বৈশিষ্ট্য কার্যকর হতে পারে। বিড়াল থেকে শুরু করে গাঙচিল পর্যন্ত, মানুষের সঙ্গে বসবাস সবসময় প্রাণীদের নরম স্বভাবের করে তোলে না। অনেক সময় একটু চাপাচাপিও সাফল্যের চাবিকাঠি হয়ে দাঁড়ায়।