এক্সোপ্ল্যানেটের সরাসরি ছবি তুলল নাসার জেমস ওয়েব, জেনেনিন কি বলছে বিজ্ঞানীরা?

মহাকাশ গবেষণায় এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হলো নাসার জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের হাত ধরে। প্রথমবারের মতো সৌরজগতের বাইরের একটি গ্রহ, যা ‘এক্সোপ্ল্যানেট’ নামে পরিচিত, তার সরাসরি ছবি তুলতে সক্ষম হয়েছে এই অত্যাধুনিক টেলিস্কোপ। এটি টেলিস্কোপটির জন্য এক যুগান্তকারী সাফল্য হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের কাছে নতুন আশার আলো দেখাচ্ছে।
সাধারণত, এক্সোপ্ল্যানেটগুলি যেহেতু খুব কম আলো ছড়ায়, তাই গবেষকরা এতদিন পরোক্ষ পদ্ধতিতেই এদের আবিষ্কার করে আসছিলেন। যেমন, কোনো গ্রহ তার মূল তারার সামনে দিয়ে অতিক্রম করার সময় তারার আলোতে যে ছায়া পড়ে, তা বিশ্লেষণ করে গ্রহের অস্তিত্ব অনুমান করা হতো। কিন্তু জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ এই পুরোনো পদ্ধতিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সরাসরি ‘টিডব্লিউএ ৭বি’ নামের একটি এক্সোপ্ল্যানেটের ছবি তুলেছে। বিজ্ঞানীদের অনুমান, এই গ্রহটির ভর আমাদের শনি গ্রহের মতো এবং এটি পৃথিবী থেকে প্রায় ১০০ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত।
এই নবাবিষ্কৃত গ্রহটি তার নক্ষত্র থেকে পৃথিবীর তুলনায় অনেক দূরে অবস্থান করছে। ফলস্বরূপ, নক্ষত্রকে একবার সম্পূর্ণ প্রদক্ষিণ করতে এর কয়েকশো বছর সময় লাগে। বিজ্ঞানীদের ধারণা, এই গ্রহ ব্যবস্থাটি মাত্র ৬০ লক্ষ বছর পুরোনো। অর্থাৎ, জেমস ওয়েব-এর ক্যামেরায় ধরা পড়েছে একটি গ্রহের বিকাশের একেবারে শুরুর দিকের এক জীবন্ত ছবি, যা যেন সৃষ্টি প্রক্রিয়ার এক চলমান মুহূর্ত। অন্যদিকে, আমাদের সূর্য প্রায় ৪৬০ কোটি বছর পুরোনো, অর্থাৎ মধ্যবয়সী অবস্থায় রয়েছে।
ক্ষুদ্রতম এক্সোপ্ল্যানেট সরাসরি ক্যামেরাবন্দি: এক বিশাল অর্জন
ব্রিটিশ দৈনিক ‘গার্ডিয়ান’-এর তথ্য অনুযায়ী, ‘টিডব্লিউএ ৭বি’ হলো টেলিস্কোপ দিয়ে সরাসরি দেখা এ পর্যন্ত সবচেয়ে ছোট আকারের এক্সোপ্ল্যানেট। এটি পূর্বের সরাসরি দেখা যেকোনো এক্সোপ্ল্যানেটের আকারের দশ ভাগের এক ভাগ। এত ছোট আকারের একটি গ্রহকে টেলিস্কোপ দিয়ে সরাসরি দেখা প্রায় অসম্ভব বলেই মনে করা হতো, কারণ মূল তারার প্রখর আলোতে গ্রহটি ঢাকা পড়ে যায়। এই কারণেই ‘টিডব্লিউএ ৭বি’-কে সরাসরি পর্যবেক্ষণ করা বিজ্ঞানীদের জন্য এক বিশাল অর্জন।
A never-before-seen planet! 🪐
This is Webb’s first discovery of a planet using direct imaging. With a mass similar to Saturn, it’s also the lightest exoplanet yet seen using this technique! https://t.co/ptWcXlFfmW pic.twitter.com/XTGwIqgH8n
— NASA Webb Telescope (@NASAWebb) June 25, 2025
সূর্যগ্রহণের মতো প্রভাব সৃষ্টি করে সমাধান: ড. অ্যান-মেরি লাগরঁজের নেতৃত্ব
এই চ্যালেঞ্জের সমাধান করেছেন গবেষণা দলটির নেতৃত্বে থাকা ড. অ্যান-মেরি লাগরঁজ। তিনি একটি বিশেষ ধরনের টেলিস্কোপিক যন্ত্র তৈরি করেছেন, যা সূর্যগ্রহণের মতো প্রভাব সৃষ্টি করে। এই যন্ত্রটি তারার অতিরিক্ত উজ্জ্বল আলোকে অনেকটাই কমিয়ে ফেলতে সক্ষম হয়েছে, যার ফলে তারার আশেপাশে লুকিয়ে থাকা ‘টিডব্লিউএ ৭বি’ গ্রহটিকে সহজেই দেখা গেছে। এই অভিনব পদ্ধতির মাধ্যমেই গবেষকরা গ্রহটিকে শনাক্ত করেছেন, যা টেলিস্কোপে উজ্জ্বল আলোর এক উৎস এবং এর চারপাশে সরু এক ধূলিকণার বলয় হিসেবে ধরা পড়েছে।
ড. লাগরঁজ এবং তার দল অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসী। যদিও তারা স্বীকার করেছেন যে, ছবিটি দূরবর্তী কোনো গ্যালাক্সির হওয়ার সম্ভাবনা ‘খুব কম’, তবে তাদের মতে, যতটুকু প্রমাণ মিলেছে তা ‘খুব জোরালোভাবে ইঙ্গিত দিচ্ছে’ এটি আসলে নবাবিষ্কৃত একটি গ্রহই।
জেমস ওয়েবের অবিরাম চমক: মহাজাগতিক রহস্য উন্মোচনে অগ্রণী ভূমিকা
প্রথম এক্সোপ্ল্যানেট আবিষ্কৃত হয় ১৯৯২ সালে, এবং তারপর থেকে প্রায় ৬,০০০ এরও বেশি এক্সোপ্ল্যানেট শনাক্ত হয়েছে। তবে এদের অধিকাংশই পরোক্ষ পদ্ধতিতে আবিষ্কার করা হয়েছে। জেমস ওয়েব-এর এই সরাসরি পর্যবেক্ষণ মহাকাশ গবেষণার এক নতুন দিগন্ত খুলে দিল।
‘এনগ্যাজেট’ লিখেছে, এটি আমাদের প্রিয় জেমস ওয়েব-এর সাম্প্রতিক চমকপ্রদ আবিষ্কারের আরও একটি উদাহরণ। সম্প্রতি এই টেলিস্কোপ ‘আইনস্টাইন রিং’ নামক মহাজাগতিক এক ঘটনারও ছবি তুলেছে, যা ঘটে যখন একটি ছায়াপথের আলো অন্য একটি ছায়াপথের ভারী মহাকর্ষের কারণে বেঁকে যায়। গত বছর, জেমস ওয়েব এ পর্যন্ত দেখা সবচেয়ে দূরের গ্যালাক্সিটিও আবিষ্কার করেছিল। মহাবিশ্বের গভীরতম রহস্য উন্মোচনে জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের এই অবিরাম প্রচেষ্টা জ্যোতির্বিজ্ঞানের ভবিষ্যৎকে আরও উজ্জ্বল করে তুলছে।