বাঙালির ভাষার অধিকারের লড়াই, ভরা বর্ষায় কলকাতা ভাসল ‘বাংলা পক্ষ’র প্রতিবাদ মিছিলে, WBCS-এ বাংলা বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়ে উত্তাল রাজনীতি

আজ (২৯শে জুন, ২০২৫) ভরা বর্ষার দিনও কলকাতার রাজপথ সহাস্র কণ্ঠে মুখরিত হলো ‘বাংলা পক্ষ’র প্রতিবাদে। পশ্চিমবঙ্গ সিভিল সার্ভিস (WBCS) পরীক্ষায় বাংলা ভাষা বাধ্যতামূলক করার সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের প্রতিবাদে একুশে উদ্যান থেকে হাজরা মোড় পর্যন্ত এক সুবিশাল মহামিছিল সংঘটিত হয়। “হিন্দি-উর্দু চলবে না, বাংলা বাধ্যতামূলক চাই!” স্লোগানে বাংলার স্বকীয়তা ও ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবি নতুন করে জোরালো হলো। বাংলা পক্ষ রাজ্য সরকারের এই সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তকে “বাঙালি বিরোধী” এবং “হিন্দি-উর্দু লবির কাছে নতিস্বীকার” হিসেবে অভিহিত করেছে।

আশাভঙ্গের চিত্র: কেন এই আন্দোলন?

দীর্ঘদিন ধরে বাংলা পক্ষ WBCS পরীক্ষায় বাংলা ভাষাকে বাধ্যতামূলক করার দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে আসছিল। তাদের নিরলস প্রচেষ্টার ফলস্বরূপ রাজ্য সরকার কিছুকাল আগে ৩০০ নম্বরের বাংলা ভাষার পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, যেখানে দার্জিলিংয়ের জন্য নেপালি ভাষার বিকল্প রাখা হয়েছিল। এই সিদ্ধান্তকে বাংলার শিক্ষা, শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতি জগতের বহু বিশিষ্টজন সমর্থন জানিয়েছিলেন। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে জমা দেওয়া ডেপুটেশনে তাঁদের স্বাক্ষরও ছিল। এমনকি, রাজ্য সরকারের মন্ত্রিসভার বৈঠকেও এই দাবি স্বীকৃতি পায় এবং বাংলা ভাষা বাধ্যতামূলক করার গেজেট নোটিফিকেশন প্রকাশিত হয়। পশ্চিমবঙ্গ পাবলিক সার্ভিস কমিশন (WBPSC) নতুন সিলেবাসে পরীক্ষার বিষয়ে নোটিফিকেশন জারি করলে WBCS পরীক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ দেখা যায়।

কিন্তু সেই আশার আলো হঠাৎই নিভে যায়। সম্প্রতি, এক আকস্মিক নোটিশে রাজ্য সরকার পূর্বের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে নেয়। নতুন নির্দেশ অনুযায়ী, আগের মতোই হিন্দি ও উর্দু ভাষাতেও WBCS পরীক্ষা দেওয়া যাবে। এই সিদ্ধান্তকে বাংলা পক্ষ “হিন্দি-উর্দু লবির চাপে আত্মসমর্পণ” এবং “বাঙালির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা” হিসেবে চিহ্নিত করেছে।

গর্গ চট্টোপাধ্যায়ের হুঙ্কার: “বাংলা ভারতের বাইরে নয়”

বাংলা পক্ষর সাধারণ সম্পাদক গর্গ চট্টোপাধ্যায় এই সিদ্ধান্তকে তীব্র ভাষায় আক্রমণ করেছেন। তিনি বলেন, “বাংলা ভারতের বাইরে নয়। ভারতের অন্যান্য রাজ্যে যেমন বিহারে হিন্দি, উত্তরপ্রদেশে হিন্দি, মহারাষ্ট্রে মারাঠি বাধ্যতামূলক, তেমনি বাংলায় বাংলা ভাষা বাধ্যতামূলক হওয়া উচিত। কিন্তু এখানে দেখা যাচ্ছে, বাংলা না জেনেও WBCS অফিসার হওয়া সম্ভব। এটা লজ্জাজনক।” তিনি শাসক ও বিরোধী দল উভয়ের দিকেই আঙুল তুলে বলেন, “শাসক ও বিরোধী দলের মধ্যে হিন্দি-উর্দু লবি ঐক্যবদ্ধ। তাদের চাপে বাঙালির ভোটে নির্বাচিত সরকার নতি স্বীকার করছে। আমরা স্পষ্ট বলছি—২০২৬ সালের নির্বাচনের আগে বাংলা বাধ্যতামূলক করতে হবে।”

বৃষ্টি উপেক্ষা করে জনতার ঢল: এক শক্তিশালী বার্তা

অবিরাম বৃষ্টির মধ্যেও এই মিছিলে হাজার হাজার মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিল চোখে পড়ার মতো। বিশেষ করে মহিলা ও ছাত্র-ছাত্রীদের উপস্থিতি ছিল উল্লেখযোগ্য। মিছিলে অংশগ্রহণকারীরা হিন্দি-উর্দু বাতিল করে বাংলা ভাষা পুনর্বহালের দাবিতে “জয় বাংলা”, “বাংলা চাই, হিন্দি-উর্দু নয়” ইত্যাদি স্লোগানে কলকাতার রাজপথ মুখরিত করে তোলেন। মিছিলটি বিড়লা প্ল্যানেটোরিয়ামের কাছাকাছি একুশে উদ্যান থেকে শুরু হয়ে হাজরা মোড়ে গিয়ে শেষ হয়।

মিছিল শেষে হাজরা মোড়ে একটি জনসভায় গর্গ চট্টোপাধ্যায় ছাড়াও বাংলা পক্ষর শীর্ষ পরিষদ সদস্যরা বক্তব্য রাখেন। তাঁরা সরকারের এই সিদ্ধান্তের তীব্র নিন্দা করেন এবং বাংলা ভাষার প্রতি অবিচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন।

এই আন্দোলন কেবল কলকাতায় সীমাবদ্ধ নয়, রাজ্যের জলপাইগুড়ি, কল্যাণী, শ্যামনগর সহ বিভিন্ন জেলাতেও বাংলা পক্ষর প্রতিবাদ কর্মসূচি চলছে। সংগঠনের সদস্যরা পোস্টারিং, সভা ও সামাজিক মাধ্যমে প্রচারের মাধ্যমে জনমত গঠন করছে। তারা দাবি করছে, বাংলা ভাষা বাধ্যতামূলক না করা হলে বাঙালির সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত পরিচয় বিপন্ন হবে।

বাংলা পক্ষর এই আন্দোলন রাজ্যের রাজনৈতিক মহলে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে এবং অনেকে মনে করছেন, এই ইস্যু আগামী ২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। বাংলা পক্ষর নেতৃত্ব স্পষ্ট করেছে যে, তারা এই আন্দোলন অব্যাহত রাখবে যতক্ষণ না বাংলা ভাষা WBCS পরীক্ষায় পুনরায় বাধ্যতামূলক করা হয়। বৃষ্টির মধ্যেও হাজার হাজার মানুষের অংশগ্রহণ প্রমাণ করে যে, বাংলা ভাষার প্রতি তাদের ভালোবাসা অটুট এবং নিজেদের অধিকার আদায়ে তারা কতটা বদ্ধপরিকর।