বিশেষ: এখনো গ্রামীণ জীবনে অনেকের ভরসা সাইকেল, আধুনিক যুগেও কমেনি জনপ্রিয়তা

সবুজ ধানের খেত, কাঁচা-পাকা মেঠো পথ, আর মাটির সোঁদা গন্ধে মাখা যে চিরচেনা গ্রামবাংলা, সেখানে আজও একটি দৃশ্য বড়ই পরিচিত। কাঁধে স্কুলব্যাগ, পায়ে হালকা ধুলোর ছাপ, আর দু’পায়ে দৃঢ় ভর দিয়ে তার বিশ্বস্ত সঙ্গী, একটি বাইসাইকেল চালিয়ে চলেছে কোনো কিশোর বা কিশোরী। শুধু সে নয়, পাশে হয়তো দেখা যাবে একজন কৃষক হাটে যাচ্ছেন, পেছনে সাইকেলের ঝুড়িতে সারি সারি সবজি। এমন দৃশ্য যেন আজও বলে দেয়, গ্রামে বাইসাইকেল কেবল একটি বাহন নয়, এটি গ্রামীণ জীবনযাত্রার এক অপরিহার্য অংশ, এক নীরব জীবনরেখা।

শহরের মানুষ যখন ট্রাফিক জ্যামে বিরক্ত হয়ে ব্যক্তিগত গাড়ি বা বাইকের পেছনে সময় ও জ্বালানি নষ্ট করে, গ্রামের মানুষ তখন জীবনের তাগিদেই নির্ভর করেন বাইসাইকেলের ওপর। এটি যেন তাদের এক নিরন্তর সঙ্গী, যা প্রতিদিনের যাত্রায় অগণিত মানুষকে সাহস ও সঙ্গ দিয়ে চলেছে।

অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য ও কার্যকারিতা

গ্রামের সাধারণ মানুষের আর্থিক অবস্থা তুলনামূলকভাবে সীমিত। প্রাইভেট কার বা মোটরসাইকেলের মালিক হওয়া অনেকের পক্ষেই অসম্ভব। তাছাড়া গ্রামের রাস্তাঘাট সবসময় মোটর-গাড়ির জন্য উপযোগীও নয়। এমন পরিস্থিতিতে সবচেয়ে কার্যকর ও সহজলভ্য সমাধান হলো সাইকেল। একটি সাইকেল মানেই এক ব্যক্তির স্বাধীন চলাচল। সেটি হতে পারে স্কুলে যাওয়া কোনো শিক্ষার্থী, বাজারে যাওয়া কৃষক, কিংবা গ্রামের কাছের কোনো আত্মীয়ের বাড়ি বেড়াতে যাওয়া।

বাইসাইকেল অনেকটা পরিবারেরই সদস্য হয়ে ওঠে। বিয়েবাড়ি যাওয়া থেকে শুরু করে জমিতে কীটনাশক পৌঁছে দেওয়া পর্যন্ত প্রায় সব কিছুতেই এর ব্যবহার চোখে পড়ে। একজন কৃষক তার বাইসাইকেলে শুধু নিজের শরীরটাই নয়, জীবনের দায়িত্বটুকুও বয়ে নিয়ে চলে। বাইসাইকেল চালাতে তেল বা লাইসেন্স লাগে না। রক্ষণাবেক্ষণও কম খরচের। একজন দিনমজুর বা কৃষকের পক্ষেও এটি একবার কিনলে বহু বছর ব্যবহার করা সম্ভব। স্কুল পড়ুয়াদের জন্য যাতায়াতে সাইকেল সবচেয়ে সুবিধাজনক। এই সাশ্রয়ী দিকটি গ্রামের মানুষের কাছে সাইকেলকে আরও গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে।

পরিবেশবান্ধব ও শিক্ষাক্ষেত্রে গুরুত্ব

পরিবেশবান্ধব বাহন হিসেবেও সাইকেলের কদর কম নয়। যেখানে পরিবেশ দূষণ ও জ্বালানি সংকট বিশ্বজুড়ে উদ্বেগের কারণ, সেখানে বাইসাইকেল চালিয়ে গ্রামীণ মানুষই পরিবেশ রক্ষায় ভূমিকা রেখে চলেছেন, হয়তো অবচেতনেই।

বিশেষ করে গ্রামে ছেলেমেয়েদের শিক্ষাজীবনে বাইসাইকেল এক বড় ভূমিকা রাখে। অনেক গ্রামে আজও মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় অনেক দূরে অবস্থিত। প্রতিদিন সেই পথ পাড়ি দিতে বাইসাইকেল ছাড়া বিকল্প নেই। হেঁটে যাওয়া যেমন কষ্টকর, তেমনি সময়সাপেক্ষও। একটি বাইসাইকেল মানেই সময় বাঁচানো, ক্লান্তি কমানো, এমনকি স্কুলে পৌঁছানোর আগ্রহটাও বাড়িয়ে দেওয়া। বিভিন্ন সময়ে সরকার গ্রামীণ ছাত্রীদের জন্য বিনামূল্যে সাইকেল বিতরণ করেছে। এতে স্কুলে উপস্থিতির হার যেমন বেড়েছে, তেমনি মেয়েদের আত্মবিশ্বাসও। একজন ছাত্রী জানে, তার স্বাধীন চলাফেরার একটি নিজস্ব হাতিয়ার রয়েছে, তা হলো তার বাইসাইকেল।

সাইকেল: এক অর্জন, এক গল্প

সাইকেল শুধু এক স্থান থেকে আরেক স্থানে যাওয়ার বাহন নয়, বরং গ্রামীণ জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। এটি শুধু চলাচলের মাধ্যম নয়, এক ধরনের অর্জনও বটে। যখন কেউ নিজের উপার্জনে একটি বাইসাইকেল কেনে, সেটা তার জন্য গর্বের ব্যাপার। অনেকটা যেন নিজের পায়ে দাঁড়ানোর প্রথম ধাপ। সাইকেল কিনতে গিয়ে কেউ হয়তো গরুর দুধ বিক্রি করেছে, কেউ টিউশনি করে পয়সা জমিয়েছে। বাইসাইকেলটি তখন তার কাছে একটা আবেগ, একটা গল্প।

তবে সবকিছুর মাঝেও কিছু সমস্যা থেকে যায়। গ্রামের অনেক রাস্তা এখনো চলাচলের উপযোগী নয়, বিশেষ করে বর্ষাকালে। কোথাও কাদামাটি, কোথাও আবার উঁচু-নিচু পথ। এসব রাস্তায় বাইসাইকেল চালানো যেমন কঠিন, তেমনি ঝুঁকিপূর্ণও। আরেকটি সমস্যা হলো বাইসাইকেল চুরি। যেহেতু অনেকের একমাত্র যানবাহন এটি, তাই চুরি হলে মানুষ কার্যত চলাচল বন্ধ করে দেয়। রক্ষণাবেক্ষণের খরচও কিছুটা বেড়েছে, বিশেষ করে যন্ত্রাংশের দাম বৃদ্ধির কারণে।

সব সমস্যার মাঝেও বাইসাইকেল যেন গ্রামের মানুষের সবচেয়ে বিশ্বস্ত সঙ্গী। হাঁটতে না চাইলে বাইসাইকেলই ভরসা। হঠাৎ কিছু দরকার হলে বাইসাইকেলই সঙ্গে নেওয়া হয়। কেউ অসুস্থ হলে, ঔষধ আনতে বাইসাইকেলই ছোটে বাজারে। এমনকি গ্রামে কোনো অনুষ্ঠানে যেতে যখন যানবাহন মেলে না, তখন পেছনে একজনকে বসিয়ে যাত্রা শুরু হয় সেই সাইকেলেই। যার দাম কম হলেও গ্রামের মানুষের কাছে এর মূল্য অসীম।