মাওবাদী নেতা বাসবরাজ খতম, ভারত থেকে শিগ্রই মুছে যাবে মাওবাদীদের সংগঠন?

ছত্তিশগড়ের অবুঝমাড়ে এলাকায় যৌথবাহিনীর এক সফল অভিযানে ভারতের অন্যতম শক্তিশালী উগ্রপন্থী সংগঠন কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়া (মাওবাদী)-র সাধারণ সম্পাদক নামবালা কেশব রাও ওরফে বাসবরাজ নিহত হয়েছেন। এই ঘটনাকে দেশের মাওবাদী নির্মূল অভিযানে এক যুগান্তকারী সাফল্য হিসেবে দেখছে ভারতীয় প্রশাসন। শীর্ষনেতার এই আকস্মিক মৃত্যু মাওবাদী সংগঠনের জন্য বিরাট ধাক্কা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে, এবং এর ফলে তাদের ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব ও সাংগঠনিক কাঠামো নিয়ে নতুন করে জল্পনা শুরু হয়েছে।
বাসবরাজ: এক অদম্য উগ্রপন্থী নেতা
ছত্তিশগড় পুলিশের DGP আরকে বীজ এই প্রসঙ্গে বলেন, “বাসবরাজ কোনো সাধারণ মাওবাদী ছিলেন না। অন্ধ্রপ্রদেশের ইঞ্জিনিয়ারিং ড্রপআউট বাসবরাজ ২০১৮ সালে গণপতির স্থলাভিষিক্ত হয়েছিলেন। তিনি দলের সাংগঠনিক রাজনীতিকে সশস্ত্র আন্দোলনের পথে চালিত করেছিলেন এবং ভারতের সবচেয়ে শক্তিশালী উগ্রপন্থী সংগঠনের প্রধান ছিলেন।”
পুলিশকর্তা আরও যোগ করেন, “এত কড়া সুরক্ষা বলয়ে চলাফেরা করা দলের সাধারণ সম্পাদক, যাঁর আশপাশে ৬০-৭০ জন সশস্ত্র মাওবাদী সবসময় ঘিরে থাকত, তাঁর মৃত্যু প্রমাণ করছে আমাদের গোয়েন্দা ব্যবস্থা (ইন্টালিজেন্স) অত্যন্ত শক্তিশালী। এই ঘটনার প্রভাব মাওবাদী ক্যাডারদের ওপর পড়েছে এবং এর ফলে আত্মসমর্পণের সংখ্যা বাড়বে।”
নেতৃত্বের শূন্যতা: বাসবরাজের উত্তরসূরি কে?
সিপিআই (মাওবাদী) একটি সাধারণ মাওবাদী সংগঠন নয়, বরং এক বহুস্তরীয় রাজনৈতিক দল যার কাঠামো তৃণমূল স্তর থেকে শুরু হয়ে শীর্ষ পদে দলের সাধারণ সম্পাদক পর্যন্ত বিস্তৃত। বাসবরাজের মৃত্যুতে বলা চলে, দলের মাথার উপর থেকে ছাদ চলে গেছে। নিরাপত্তাবাহিনীর ধারাবাহিক অভিযানের জেরে মাওবাদী সংগঠনের বহু প্রথম সারির নেতা নিহত হয়েছেন অথবা আত্মসমর্পণ করেছেন। বর্তমানে পলিটব্যুরোর জীবিত ও সক্রিয় সদস্যের সংখ্যা মাত্র ৩ জন। এই পরিস্থিতিতে বাসবরাজের শূন্যস্থান কে পূরণ করবেন, তা নিয়ে জোর জল্পনা চলছে। সম্ভাব্য উত্তরসূরি হিসেবে দুটি নাম উঠে আসছে:
থিপ্পিরি তিরুপতি ওরফে দেবজি: তিনি একজন কট্টর ফিল্ড কমান্ডার এবং ১৯৯০ সালের পিপলস ওয়ার গ্রুপের সময় থেকে সক্রিয়। ২০০৭ সালে তাঁর নেতৃত্বেই দান্তেওয়াড়াতে গীদম থানা এলাকায় হামলা হয়েছিল। বর্তমানে তিনি দলের কেন্দ্রীয় সামরিক কমিটির সদস্য। এই পদেই সাধারণ সম্পাদক হওয়ার আগে ছিলেন বাসবরাজ। আরকে বিজের মতে, “দেবজি কেবলমাত্র অপারেশনাল কমান্ডার নন বরং রণনীতিকারও। তবে রাজনীতিটা ততটাও বোঝেন না যতটা সাধারণ সম্পাদক হিসেবে বোঝা উচিত।”
বেণুগোপাল রাও ওরফে ভূপতি: তিনি এমন একজন নেতা যিনি রাজনীতি এবং সামরিক নীতি দুটিতেই সিদ্ধহস্ত। ১৯৯৫ সালে দণ্ডকারণ্য স্পেশাল জোনাল কমিটি গঠনে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। তেলুগু, হিন্দি এবং গোন্ডি ভাষায় পারদর্শী হওয়ায় আদিবাসীদের মধ্যে তাঁর প্রভাব ব্যাপক। বর্তমানে তিনি কেন্দ্রীয় ব্যুরোর প্রধান, যা ছত্তিশগড়, উত্তর তেলঙ্গানা, মহারাষ্ট্র এবং ওড়িশার মাওবাদী গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করে। তবে তাঁর দুর্বলতা হলো বয়স; বর্তমানে ৭০ ছুঁইছুঁই এই মাওবাদী নেতা নেতৃত্বের ক্ষেত্রে সমস্যার সম্মুখীন হতে পারেন।
বাসবরাজের মৃত্যুর পর প্রথম সারির এই দুই নেতার নামই তাঁর সম্ভাব্য উত্তরসূরি হিসেবে উঠে আসছে।
সংগঠনের ভবিষ্যৎ: ভাঙন নাকি বিকেন্দ্রীকরণ?
একটা সময়ে এই সংগঠন গোটা দেশে ৫টি জোনাল ব্যুরো চালাত। বর্তমানে তা সীমিত হয়ে কেবলমাত্র দুই কেন্দ্র এবং এক পূর্ব ব্যুরো পর্যন্ত দাঁড়িয়েছে। একজন সাধারণ সম্পাদক কেন্দ্রীক হওয়ার পরিবর্তে পার্টি যদি একটি বিকেন্দ্রীকরণ নেতৃত্ব মডেল তৈরি করে, তাহলে তারা লাভবান হবে বলে মনে করা হচ্ছে। আরকে বিজের বক্তব্য, “এটা ওদের ভাঙনের শুরু।”
এই শীর্ষনেতার মৃত্যু মাওবাদী সংগঠনের ভবিষ্যতকে কোন দিকে নিয়ে যায়, সেটাই এখন দেখার বিষয়।