বিশেষ: চাল মাপার ‘সের’ হারিয়ে গেলেও ‘মন’ ওঠেনি মন থেকে, আজও বহন করছে বাংলার ঐতিহ্য

দেশীয় রীতিতে ওজন পরিমাপের বা ভারের একক ‘সের’। আমাদের দেশে মেট্রিক পদ্ধতি চালু হওয়ার আগে দেশীয় রীতিতে পরিমাপ পদ্ধতি প্রচলিত ছিল। আর এই দেশীয় রীতিতে ওজন পরিমাপের একটি একক সের হওয়ায়, ওজন পরিমাপের বস্তুটিও ছিল বহুল পরিচিত। শুধু সের-ই নয়, দেশীয় রীতিতে আরো পরিমাপের একক আছে; তোলা, পোয়া, ছটাক, মণ ইত্যাদি।
তোলা, পোয়া, ছটাক, সের কিংবা মণ—গ্রামীণ ঐতিহ্য এসব পরিমাপক বানানো হতো বেত দিয়ে। আবার অনেকে বাঁশও ব্যবহার করতেন। তবে বেতের তৈরি ‘সের’-ই বেশি সমাদৃত ছিল। এক সময় এই ‘সের’ দিয়ে শস্য পণ্য মাপার কাজ করা হতো। বিশেষ করে চাল মাপার কাজে সের-এর গ্রহণযোগ্যতা ছিল একক ও আকাশচুম্বী।
এখনো, দেশের বেশ কিছু জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে ‘সের’-এর ব্যবহার এখনো চোখে পড়ে। গ্রামীণ রীতিতে এখনো সের কথাটি অনেকভাবেই প্রচলিত আছে। সেসব জায়গাতে সেরকে কিলোগ্রাম হিসেবে ব্যবহার করা হয়। তবে দেশের মফস্বল কিংবা জেলা শহরে এখন এই পরিমাপকের অস্তিত্বই পাওয়া যায় না। একসময় চাকচিক্যের শহরেও এই সের-এর রাজত্ব ছিল। তখন সবার মুখে মুখে ছিল- ‘আশি তোলায় সের, চল্লিশ সেরে মণ’।
১৯৮২ সালের পহেলা জুলাইয়ের পূর্ববর্তী সময় পর্যন্ত সময়ে বহুলভাবেই প্রচলিত ছিল। আর ১৯৮২ সালের পহেলা জুলাইয়ে আমাদের দেশে ম্যাট্রিক পদ্ধতি চালু হওয়ার পর ধীরে ধীরে এই দেশীয় রীতির পরিমাপ পদ্ধতিটি বিলুপ্ত হয়। আশির দশকে রেডিও খুবই জনপ্রিয় ছিল। তখন দীর্ঘদিন ধরেই রেডিওতে একটি ঘোষণা দেওয়া হয়, ‘১ জুলাই থেকে মেট্রিক পদ্ধতির প্রচলন করা হয়েছে, তাই আর বাংলা পদ্ধতিতে পরিমাপ চলবে না এখন মেট্রিক পদ্ধতি ব্যবহার করতে হবে। সেরের পরিবর্তে কেজি…. ইত্যাদি।’
সের একটি পরিমাপের একক যা ভর পরিমাপের জন্য এক সময় বাংলায় এবং ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যবহৃত হতো। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইরান এ অঞ্চলের শব্দটি খুবই পরিচিত। ১ সের প্রায় ৯৩৩.১ গ্রাম (একক) এর সমান।
হারিয়ে যাওয়ার পথে…
ছটাক: ওজনের পরিমাণ হিসাবে ছটাক অনেক আগে থেকেই এটি ব্যবহৃত হত। পাঁচ তোলা বা ১/১৬ সের সাধারণত ওজনের ক্ষেত্রে ছটাক। এটি আবার অনেক স্থানে জমির পরিমাপেও ব্যবহৃত হয়। জমির পরিমাণে এটি ২০ বর্গ হাত বা ১/১৬ কাঠা। তবে ব্যবহার খুবই কম।
পোয়া: মুঘল আমল থেকেই পোয়ার ব্যবহারের তথ্য পাওয়া যায়। ১ পোয়া সাধারণত এক সেরের চারভাগের একভাগ বা সিকিভাগ। তবে আশার কথা হল, পোয়া এখনো বিলুপ্ত হয় নি। সাধারণ মানুষ ২৫০ গ্রামকে এখনো পোয়া হিসেবে ব্যবহার করেন। মজার ব্যাপার হল বাংলাদেশে ছোট মাছ ক্রয়ের একক এখন পোয়া।
ধরা: ধরা হলো বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের একটি পরিমাপ। খুবই প্রাচীনকাল থেকে এটি ব্যবহৃত হত, বিশেষকরে পাট মাপতে। তবে এখন আর তেমন প্রচলন নেই। ৫ সেরে এক ধরা হত।
মন: ব্রিটিশ ভারতে, ১৮৩৩ সালে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সিতে মনকে প্রথম প্রমিত করা হয়, যেখানে এটি ১০০ ট্রয় পাউন্ডের (৮২.২৮ পাউন্ড) সমান সেট করা হয়েছিল। এই মানটি পুরো ব্রিটিশ সাম্রাজ্যজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। ভারত ও পাকিস্তানের স্বাধীনতার পরে সংজ্ঞাটি পরবর্তীতে মেট্রিক পদ্ধতির ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়। এক মন সাধারণত ৪০ সের বা ৩৭.৩২২২ কিলোগ্রাম হয়ে যায়। একই সংজ্ঞা নেপালেও ব্যবহৃত হত।
তবে মন কিন্তু উধাও হয়নি! মানুষের মন থেকে কি ‘মন’ এত সহজে বিদায় হয়? ‘মন’ রয়ে গেছে বহাল তবিয়তে! এখনো ব্যাপকভাবে পরিমাপের একক পদ্ধতিতে ধান, পাট গম, ভুট্রো প্রভৃতিতে মন শব্দটি ব্যবহৃত হয়। তবে ঠিকই হারিয়ে গেল ‘সের’…।