“পাকিস্তানকে জলে মারার কৌশল”-পাকিস্তানের কঠিন পরিস্থিতি, হয় বন্যা, নয়তো জলকষ্ট

কাশ্মীরের পহেলগামে ভয়াবহ জঙ্গি হানার পর পাকিস্তানের সঙ্গে যখন ভারতের সম্পর্ক তলানিতে ঠেকেছে, তখনই জল-কূটনীতিকে হাতিয়ার করে ইসলামাবাদকে প্রবল চাপে ফেলেছে নয়া দিল্লি। ২২ এপ্রিলের জঙ্গি হামলার পরদিনই পাকিস্তানের যোগসূত্র সামনে আসার পর ভারত সিন্ধু জলচুক্তি নিয়ে আলোচনার প্রক্রিয়া স্থগিতের ঘোষণা করেছে। একইসঙ্গে স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, সিন্ধু নদের এক ফোঁটা জলও আর পাকিস্তানে যাবে না। শুধু সিন্ধু নয়, চন্দ্রভাগা ও বিতস্তা নদীর জলবণ্টনেও ভারত রাশ টানতে শুরু করেছে। কিন্তু এই পদক্ষেপের পর থেকেই প্রশ্ন উঠছিল, পাকিস্তানের দিকে জলপ্রবাহ বন্ধ রাখলে সেই বিপুল পরিমাণ অতিরিক্ত জল ধরে রাখার মতো পরিকাঠামো বা পর্যাপ্ত জলাধার কি ভারতের হাতে রয়েছে? এই প্রেক্ষাপটেই সামনে এসেছে ভারতের এক কৌশলগত পরিকল্পনা।
চুক্তির জটিলতা ও ভারতের আটকে থাকা প্রকল্প
সিন্ধু জলচুক্তি অনুযায়ী, সিন্ধু, চন্দ্রভাগা এবং বিতস্তা— এই তিনটি নদীর ঊর্ধ্বগতির জল সীমিত শর্তে ব্যবহারের অধিকার ভারতের রয়েছে। এই জল মূলত কৃষিকাজ ও জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের মতো অ-ব্যবহারযোগ্য (non-consumptive) কাজে ব্যবহার করা যায়। অন্যদিকে, এই নদীগুলোর মোট জলের প্রায় ৮০ শতাংশ যায় পাকিস্তানে, যা তাদের বিস্তীর্ণ এলাকার জলসেচের প্রধান উৎস এবং অর্থনীতির লাইফলাইন। চুক্তি অনুসারে, ভারত এই নদীগুলোর উপর শুধুমাত্র জলবিদ্যুৎ তৈরির পরিকাঠামো গড়তে পারে, কিন্তু বড়সড় জলাধার তৈরি করতে গেলে পাকিস্তানের অনুমোদন আবশ্যক। চুক্তির এই ধারার ফাঁক ব্যবহার করে পাকিস্তান বারবার নানা রকম আপত্তি তোলায় ভারতের গুরুত্বপূর্ণ ছয়টি জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজ বছরের পর বছর ধরে আটকে রয়েছে। অথচ, এই প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হলে জম্মু ও কাশ্মীরের বিদ্যুৎ এবং জলের সমস্যা অনেকটাই মিটে যেত এবং ভারত অতিরিক্ত জল ধরে রাখতে পারত।
পলি সাফাইয়ের কৌশল: একদিকে জল ধরে রাখা, অন্যদিকে পাকিস্তানের জন্য বিপদ
সিন্ধু জলচুক্তি স্থগিত থাকায় ভারত এখন এই দীর্ঘদিন ধরে আটকে থাকা কাজগুলো সম্পন্ন করার সুযোগ পাচ্ছে। চুক্তি অনুযায়ী কোনো নির্মাণ বা মেরামতির কাজের জন্য পাকিস্তানকে আগে থেকে নোটিস দেওয়ার যে বাধ্যবাধকতা ছিল, ভারত এখন আর তা মানতে বাধ্য নয়। বিশেষজ্ঞরা মানছেন যে রাতারাতি বিশাল নতুন জলাধার তৈরি সম্ভব নয়, যা পাকিস্তানের দিকে জলের সরবরাহ সম্পূর্ণ বন্ধ করার জন্য জরুরি। কিন্তু ভারত বর্তমানে সালাল এবং বাগলিহরের মতো পুরোনো বাঁধগুলোর জলাধারে জমে থাকা পলি বা সেডিমেন্ট পরিষ্কার করার কাজ শুরু করেছে। পলি পরিষ্কারের জন্য জলাধারের অনেকটাই জল ছাড়তে হয়, যা পাকিস্তানের downstream এলাকায় বন্যা সৃষ্টি করতে পারে। এতদিন এই আশঙ্কায় ভারত ১৯৮৭ এবং ২০০৯ সালে তৈরি হওয়া বাঁধগুলোর পলি পরিষ্কার করেনি। কিন্তু সিন্ধু জলচুক্তি স্থগিত হওয়ার সুযোগে ভারত এখন সেই কাজ শুরু করেছে এবং গত সপ্তাহেই এই জল ছাড়ার ফলে পাকিস্তানের কিছু অংশ আকস্মিক বন্যায় প্লাবিত হয়েছে।
দ্বিমুখী লাভ ভারতের, চাপে পাকিস্তান
কিন্তু এই জল ছাড়ার ঘটনা ভারতের জন্য দ্বিমুখী সুবিধা বয়ে এনেছে। প্রথমত, পলি পরিষ্কারের পর জলাধারটিতে অতিরিক্ত জল ধরে রাখা সম্ভব হবে, যা আর পাকিস্তানের দিকে প্রবাহিত হবে না। দ্বিতীয়ত, পলি সরে যাওয়ায় ভারতের নিজস্ব জলবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের টারবাইনগুলোর কর্মক্ষমতা এবং বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতাও বৃদ্ধি পাবে। সেন্ট্রাল ওয়াটার কমিশনের প্রাক্তন প্রধান কুশবিন্দর ভোহরা এই কৌশলকে সমর্থন করে বলেছেন, “পাকিস্তানের দিকে জলের সরবরাহ সম্পূর্ণ বন্ধ করতে গেলে ভারতকে অবশ্যই নতুন জলাধার তৈরি করতে হবে। তবে আপাতত কিছু সময়ের জন্য পুরোনো জলাধারগুলোতে পলি পরিষ্কার করে অতিরিক্ত জল ধরে রাখা সম্ভব হবে, এবং এর মাধ্যমে পাকিস্তানের উপর একটি উল্লেখযোগ্য চাপ সৃষ্টি করা যাবে।” এই গুরুত্বপূর্ণ পরিস্থিতি পর্যালোচনা করতে চলতি সপ্তাহেই ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ জলসম্পদ মন্ত্রী সিআর পাটিল, শক্তিসম্পদ বিষয়ক মন্ত্রী এমএল খাট্টার এবং কৃষিমন্ত্রী শিবরাজ সিং চৌহানের সঙ্গে একটি উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে বসবেন।
পাকিস্তানের কঠিন পরিস্থিতি: হয় বন্যা, নয়তো জলকষ্ট
এই সমস্ত ঘটনাপ্রবাহ মিলিয়ে পাকিস্তানের সামনে এখন এক অত্যন্ত কঠিন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। হয় ভারতের ছাড়া জলে তাদের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হতে হবে, নয়তো জলপ্রবাহ কমে যাওয়ায় তীব্র জলকষ্টে ভুগতে হবে, যা তাদের কৃষিনির্ভর অর্থনীতিকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করবে। ভারতের এই কৌশলগত এবং কূটনৈতিক চাপের প্যাঁচটা পাকিস্তানের সাধারণ মানুষও বেশ ভালোভাবে উপলব্ধি করতে পারছেন। আর ঠিক এই কারণেই, সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া কয়েকটি ভিডিওতে (যদিও এই ভিডিওগুলোর সত্যতা স্বাধীনভাবে যাচাই করা যায়নি) দেখা যাচ্ছে পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ যুদ্ধের পক্ষে নন। ইসলামাবাদে অবস্থিত লাল মসজিদের ইমাম সরাসরি প্রশ্ন তুলছেন, “ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ বাধলে কারা পাকিস্তানকে সমর্থন করবেন?” আশ্চর্যের বিষয় হলো, মসজিদে উপস্থিত একজন পাকিস্তানিকেও এই প্রশ্নের জবাবে হাত তুলতে দেখা যায়নি। অন্যদিকে, খাইবার পাখতুনখোয়ার এক মৌলানাকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর উদ্দেশে বলতে শোনা যাচ্ছে, “আপনারা পাশতুনদের অনেক কষ্ট দিয়েছেন, আর এখন ভাবছেন যুদ্ধ লাগলে আমরা আপনাদের পাশে থাকব? মোটেই না।” শোনা গেছে, সাধারণ মানুষও মৌলানার এই বক্তব্যের সঙ্গে সহমত পোষণ করেছেন।
বিশ্লেষকদের মত: কূটনীতির ফাঁদে ইসলামাবাদ
ওয়াকিবহাল মহলের একাংশ মনে করছেন, ভারত অত্যন্ত সুকৌশলে কূটনৈতিক চাল চেলে পাকিস্তানকে কোণঠাসা করে ফেলেছে। আফগানিস্তানের প্রাক্তন ভাইস প্রেসিডেন্ট আমরুল্লা সালেহের একটি ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য এই পরিস্থিতিকেই আরও ভালোভাবে তুলে ধরেছে। সালেহ বলেছেন, “মনে হচ্ছে, ভারত শত্রুকে ইলেকট্রিক চেয়ারে বসিয়ে এক ঝটকায় শেষ না করে, তার গলায় লম্বা দড়ি পেঁচিয়ে তিলে তিলে মারবে…” এই মন্তব্য থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, ভারত এখন সামরিক শক্তির চেয়েও বেশি করে কৌশলগত এবং কূটনৈতিক চাপকে হাতিয়ার করছে পাকিস্তানকে কাবু করার জন্য।