“সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা যারা করে, তাদের আমরা…?”-মুর্শিদাবাদ কাণ্ডে বিজেপিকে নিশানা মমতার

মুর্শিদাবাদের সাম্প্রতিক হিংসার ঘটনার তিন সপ্তাহ পর অবশেষে জেলা সফরে এসে শান্তি ও সম্প্রীতির বার্তা দিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সোমবার বহরমপুরে পৌঁছে তিনি পুনরায় স্পষ্ট করে বলেন যে, যখন তিনি রাজনীতি করেন বা প্রশাসনিক দায়িত্বে থাকেন, তখন তাঁর কাছে সমস্ত ধর্মই সমান এবং মানুষে মানুষে কোনো ভেদাভেদ তিনি পছন্দ করেন না। এই সফরের মাঝেই নাম না করে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এবং তাঁর দল বিজেপিকে তীব্র আক্রমণ শানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী।
উল্লেখ্য, কয়েক সপ্তাহ আগে সংশোধিত ওয়াকফ আইন নিয়ে প্রতিবাদকে কেন্দ্র করে মুর্শিদাবাদের কয়েকটি অংশে অশান্তি ছড়িয়েছিল, যার ফলস্বরূপ তিনজনের প্রাণহানি হয়। এই ঘটনার পর বিরোধী দলের প্রতিনিধিরা একাধিকবার ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শনে গিয়েছিলেন। অশান্তির পর এটি ছিল মুখ্যমন্ত্রীর প্রথম মুর্শিদাবাদ সফর।
পরিবার বিতর্ক: তৃণমূল-বিজেপি টানাপোড়েন
মুখ্যমন্ত্রীর সফরের ঠিক আগে সামশেরগঞ্জের জাফরাবাদে নিহত বাবা-ছেলের পরিবারকে ঘিরে নতুন করে রাজনৈতিক বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। নিহত হরগোবিন্দ দাস ও তাঁর ছেলের পরিবারের কয়েকজন সদস্য কলকাতা চলে এসেছেন এবং হাইকোর্টে মামলা দায়েরের উদ্যোগ নিয়েছেন। এই জোড়া হত্যাকাণ্ডের সিবিআই তদন্ত চেয়ে সোমবার তাঁরা বিচারপতি তীর্থঙ্কর ঘোষের এজলাসে আবেদন জানিয়েছেন। মুর্শিদাবাদে এসেও ওই পরিবারের সঙ্গে দেখা না হওয়ায় মুখ্যমন্ত্রী আক্ষেপ প্রকাশ করেন এবং অভিযোগ করেন যে, বিজেপি ওই পরিবারের সদস্যদের সরিয়ে নিয়ে গেছে যাতে তিনি দেখা করতে না পারেন।
অন্যদিকে, দাস পরিবারের সদস্যরা এদিন হাইকোর্টে দাবি করেন যে, পুলিশ নাকি তাদের আটক করার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু তারা স্বেচ্ছায় কলকাতায় এসেছেন। মুখ্যমন্ত্রী জানান, তিনি আন্তরিকভাবেই ওই পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু বিজেপির প্ররোচনায় তা সম্ভব হয়নি। প্রসঙ্গত, জাফরাবাদে এই হত্যাকাণ্ডের পর বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী ওই পরিবারের হাতে আর্থিক সাহায্য তুলে দিয়েছিলেন। এই সাহায্যের প্রসঙ্গ সরাসরি উল্লেখ না করে মুখ্যমন্ত্রী এদিন বলেন, “আমি ওদের হাতে ১০ লক্ষ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দিয়ে আসতাম। আপনারা (বিজেপি) কেন ওদের লুকিয়ে নিয়ে গেলেন? এখন ওদের দিয়ে আমাকে গালিগালাজ দেওয়ানো হচ্ছে! আপনারা গণ্ডগোল পাকাবেন, আর গালিগালাজ আমি শুনব?” তিনি আরও যোগ করেন, “বিজেপির এটা বোঝা উচিত যে, যারা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা করে, তাদের আমরা ক্রিমিনাল হিসেবেই দেখি। তাদের ক্ষেত্রে কোনো ধর্ম, বর্ণ বা জাতির ভেদাভেদ করি না।”
এদিকে, নিহতের ছোট ছেলে এদিন কলকাতায় শুভেন্দু অধিকারীর পাশে দাঁড়িয়ে পুলিশের বিরুদ্ধে জোর করার অভিযোগ আনেন। তিনি বলেন, “আমি যেখানেই গেছি, সেখানেই পুলিশ প্রহরা ছিল। আমাকে দিয়ে কিডন্যাপের কথা লেখানোর চেষ্টা হয়েছে।” তিনি স্পষ্ট জানান, তাঁর মা সম্পূর্ণ নিজের ইচ্ছায় কলকাতায় এসেছেন এবং পুলিশ তাদের উপর চাপ সৃষ্টি করছিল ও টাকা-চাকরির টোপ দিচ্ছিল। তিনি বলেন, তারা টাকা বা চাকরি কিছুই নেবেন না। এই প্রসঙ্গে শুভেন্দু অধিকারী বলেন, “ওই পরিবার রাজনৈতিকভাবে কোন দলের, সেটা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়। সবার আগে উনি হিন্দু। একজন হিন্দু বিপদে পড়লে তাঁকে আগলে রাখাই প্রকৃত হিন্দুর কর্তব্য।” এই ঘটনায় সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম মন্তব্য করেন যে, বিজেপি এবং তৃণমূল নিহত পরিবারকে নিয়ে ক্ষমতার লড়াইয়ে নেমেছে, যদিও শেষকৃত্যের সময় কেউ পাশে ছিল না।
মুখ্যমন্ত্রীর নিশানায় শাহ, বিএসএফ ও কেন্দ্রীয় সংস্থা
মুর্শিদাবাদের সাম্প্রতিক অশান্তির জন্য নাম না করেও মুখ্যমন্ত্রী কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এবং তাঁর দলকে কঠোরভাবে আক্রমণ করেন। বহরমপুরে তিনি অমিত শাহকে দেশের ‘অ্যাক্টিং প্রাইম মিনিস্টার’ বলেও কটাক্ষ করেন। তিনি বলেন, “কিছু লোক ধর্মগুরু সেজে ধর্মের নামে অধর্মের কথা বলছে। তারাই অশান্তি সৃষ্টিকারী, তারাই বাংলার শত্রু।” তিনি আরও বলেন, “মুর্শিদাবাদে চক্রান্ত করে অশান্তি বাধানো হয়েছে। কারা এবং কীভাবে এটা করিয়েছে, আমি সব খতিয়ে দেখছি। তথ্য হাতে পেলেই প্রকাশ করব।” তিনি অভিযোগ করেন, বিএসএফ গুলি না চালালে ধুলিয়ানে এত বড় অশান্তি হতো না। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “আমি প্রধানমন্ত্রী (নরেন্দ্র মোদী) সম্পর্কে কিছু বলছি না। আমি অ্যাক্টিং প্রাইম মিনিস্টারকে নিয়ে কথা বলছি।” তিনি প্রশ্ন তোলেন, “এখন দেশের অ্যাক্টিং প্রাইম মিনিস্টার কে?” এবং বলেন, “যতক্ষণ আপনি একটি গুরুত্বপূর্ণ চেয়ারে আছেন, ততক্ষণ মানুষে মানুষে ভেদাভেদ করতে পারেন না।”
মুখ্যমন্ত্রী এদিন কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলির ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন। তিনি বলেন, “ঘটনা ঘটার পরের দিনই মানবাধিকার কমিশন চলে এল! কই মণিপুর, উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান বা দিল্লিতে তো যায় না! এখানে শুধু উস্কানি দেওয়া হচ্ছে।” নাম না করে তিনি ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের এক সন্ন্যাসীর বিরুদ্ধেও উস্কানি দেওয়ার অভিযোগ তোলেন। তিনি বলেন, “এখানে একটি সংগঠন আছে, যার একজন নেতা উস্কানি দেন। অশান্তির সময় তিনি নাকি ৪৮ ঘণ্টা আলো নিভিয়ে রেখেছিলেন। কেন এমন করলেন? কী লুকাতে চেয়েছিলেন?” তবে তিনি এও বলেন যে, ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের দিলীপ মহারাজকে তিনি শ্রদ্ধা করেন এবং গঙ্গাসাগরে সেখানকার সঙ্ঘ তাদের সাহায্য করে, কিন্তু এখানকার বিষয়টি আলাদা।