“কাশ্মীরে বাবাকে হারিয়ে দুই ভাইকে পেয়েছি, জ়ামির আর মুজাফির’”-জানালেন কোচির আরতি

কাশ্মীরের পহেলগামের বৈসরন ভ্যালিতে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ জঙ্গি হামলায় নিজের বাবাকে হারিয়েছেন। নিজে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছেন অলৌকিকভাবে। সেই ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে এখনও শিউরে উঠছেন কোচীর বাসিন্দা আরতি। চোখের জলে ভেসে যাচ্ছে তার মুখ, কাঁপছে গলা। তিনি শোনালেন সেই কালো মঙ্গলবারের দুঃস্বপ্ন।

আরতি জানান, সেদিন বৈসরন ভ্যালির আকাশ ছিল ঝকঝকে, সবুজ তৃণভূমিতে সোনালি আলো খেলা করছিল। আচমকাই তিনি শুনতে পান ‘গুড়ুম’ শব্দ। প্রথমটা বুঝতে পারেননি। কিন্তু পাহাড়ে প্রতিধ্বনি তুলে যখন ওই শব্দটাই আবার ফিরে আসে, তখন আর কোনো সংশয় ছিল না তার মনে। হ্যাঁ, ওটা গুলির শব্দই ছিল।

মুহূর্তেই বৈসরন ভ্যালিতে হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। যে যেদিকে পারছিলেন প্রাণভয়ে ছুটছিলেন। আরতির সঙ্গে ছিলেন তার বাবা রামচন্দ্রন, মা এবং তার যমজ সন্তান। পড়ি কি মরি করে সবাই ছুটতে শুরু করেন কাছের পাইন বনের দিকে। আরতির মাথায় তখন একটাই চিন্তা— বাবা আর সন্তানদের যে কোনো মূল্যে বাঁচাতে হবে।

তবে শেষ রক্ষা হয়নি। হামলাকারীর দল তাদের দেখতে পেয়ে এগিয়ে আসে। আরতি জানান, আচমকাই যমদূতের মতো উদয় হয় এক জঙ্গি। তাদের দিকে তাকিয়ে সে কিছু একটা বলেছিল। আরতি আর তার বাবার পক্ষে সেই ভাষা বোঝা সম্ভব হয়নি। তারা হিন্দিতেই জঙ্গিকে বলেন, “কী বললেন কিছুই বুঝলাম না।”

আরতি জানান, এর বেশি কিছু বলার সুযোগই তারা পাননি। জঙ্গিরা রামচন্দ্রনকে লক্ষ্য করে গুলি চালায়, একেবারে মাথায়। সেখানেই লুটিয়ে পড়েন তিনি। চোখের সামনে বাবার এমন পরিণতি দেখে নিজেকে ধরে রাখতে পারেননি আরতি। তীব্র চিৎকার করে কেঁদে ওঠেন তিনি। ঠিক তখনই এক জঙ্গি আরতির মাথায় বন্দুক ধরে।

এই ঘটনার কথা বলতে গিয়ে আরতি এখনও শিউরে ওঠেন। তিনি বলেন, “মুহূর্তের জন্য মনে হলো সব শেষ। বাচ্চাদের কী হবে, ওদের কে দেখবে, শুধু সেটাই ভাবছিলাম।” ঠিক তখনই যেন অলৌকিকভাবে জঙ্গিটি তার মাথা থেকে বন্দুক সরিয়ে নেয়। তার মতে, হয়তো তার সঙ্গে থাকা ছোট ছোট বাচ্চাদের কথা ভেবেই জঙ্গিরা আর গুলি চালায়নি।

আরতির কাছে কাশ্মীর তার বাবাকে কেড়ে নিয়েছে, কিন্তু দিয়েছে দুই ভাইকে। এমনটাই বলছেন তিনি স্বয়ং। বাবার মৃ্ত্যুর পর সন্তানদের নিয়ে পাহাড়ি পথ বেয়ে সাহায্যের খোঁজে ছুটতে শুরু করেন আরতি। তিনি জানান, ওই চরম মুহূর্তে তিনি তাদের গাড়ির চালককে ফোন করার চেষ্টা করছিলেন, কিন্তু সেখানে কোনো সিগন্যাল ছিল না। প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট পর তার ফোনে যোগাযোগ সম্ভব হয়।

আরতির কাছ থেকে ফোন পেতেই তাদের চালক জ়ামির একটুও দেরি না করে ঘটনাস্থলে চলে আসেন। এরপর থেকে তিনি এবং কাশ্মীরেরই আরেক যুবক মুজ়াফির আরতির পাশেই ছিলেন। রামচন্দ্রনের দেহ নিয়ে আসা, সেটি শনাক্ত করা, মর্গে নিয়ে যাওয়া— পুরো কঠিন সময়টাতে তারা দুজন আরতির সঙ্গ ছাড়েননি। তাদের এই সাহায্যের কথা কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করে আরতি বলেন, “কাশ্মীর ছাড়ার আগে ওদের বলে এসেছিলাম, আমি বাবাকে হারালেও আজ দুই ভাইকে পেলাম।” সন্ত্রাসবাদের বীভৎসতার মাঝে কাশ্মীরের সাধারণ মানুষের এই মানবিকতা আরতির মনে এক গভীর দাগ কেটে গেছে।