বিশেষ: ভেলভেট পিঁপড়ার হুলের কামড়ে এতো জ্বালা কেন? জেনেনিন কি বলছে গবেষকরা?

‘স্কারলেট ভেলভেট অ্যান্ট’ নামে পরিচিত এই পিঁপড়া আসলে এক ধরনের বোলতা, যার হুলের তীব্র যন্ত্রণা গরম তেল ছড়িয়ে পড়ার মতো অনুভূতি দেয়। এর বিষে মৃত্যু না হলেও জ্বালাপোড়ার মতো তীব্র ব্যথা প্রাণীজগতের অন্যতম ভয়ঙ্কর হুলের তালিকায় নিয়ে গেছে এটিকে। সম্প্রতি বিজ্ঞানভিত্তিক জার্নাল ‘কারেন্ট বায়োলজি’তে প্রকাশিত এক গবেষণায় এই যন্ত্রণার রহস্য উন্মোচিত হয়েছে, যা চিকিৎসা গবেষণার জন্য নতুন দ্বার খুলতে পারে।
হুলের প্রকৃতি ও উদ্দেশ্য
দক্ষিণ ও পূর্ব যুক্তরাষ্ট্রের শুকনো, বালুকাময় পরিবেশে বসবাসকারী এই ভেলভেট পিঁপড়ারা তাদের উজ্জ্বল লাল-কালো রঙের জন্য সহজেই চেনা যায়। গবেষকদের মতে, এরা হুল শিকার ধরার জন্য নয়, বরং প্রতিরক্ষার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। বিজ্ঞানভিত্তিক সাইট নোরিজের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এদের হুল শিকারীদের দূরে রাখতে সতর্কতা হিসেবে কাজ করে। এরা প্রধানত মধু ও অন্যান্য পোকামাকড়ের পোষক খুঁজে বেড়ায়।
বিষের রহস্য উন্মোচন
গবেষকরা ফলের মাছির ওপর পরীক্ষা চালিয়ে এই বিষের কার্যপ্রণালী বোঝার চেষ্টা করেছেন, যা জৈবিক গবেষণায় বহুল ব্যবহৃত একটি মডেল। গবেষণায় দেখা গেছে, ভেলভেট পিঁপড়ার বিষ দেহের ব্যথা-সংবেদনশীল স্নায়ু কোষ বা ‘নোকিসেপ্টর’-এর সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করে। এই কোষগুলো তাপ বা চাপের মতো ক্ষতিকর উদ্দীপনা শনাক্ত করে।
বিষের মূল উপাদান হিসেবে শনাক্ত হয়েছে ‘ডো৬এ’ নামের একটি পেপটাইড—অ্যামাইনো অ্যাসিডের ছোট চেইন। এটি দেহের আয়ন চ্যানেলগুলোকে সক্রিয় করে, যা চার্জিত কণার চলাচল নিয়ন্ত্রণ করে এবং স্নায়ু কোষে ব্যথার অনুভূতি জাগায়। গবেষকরা জানান, পোকামাকড় ও স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যে এই আয়ন চ্যানেল একই রকম, তবে বিষের প্রভাব ভিন্ন। পোকামাকড়ের স্নায়ু কোষে ‘ডো৬এ’ তীব্রভাবে সক্রিয় হয়, যেখানে স্তন্যপায়ীদের ক্ষেত্রে এটি তুলনামূলকভাবে কম প্রভাব ফেলে।
পরীক্ষা ও ফলাফল
ইঁদুরের ওপর পরীক্ষায় দেখা গেছে, অন্যান্য যৌগের তুলনায় ‘ডো৬এ’ সরাসরি কম যন্ত্রণা সৃষ্টি করে। তবে এটি প্রকৃতির প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার একটি নিখুঁত উদাহরণ। গবেষকদের মতে, এই বিষ শিকারীদের ভয় দেখাতে এবং আক্রমণ থেকে বাঁচতে সাহায্য করে।
চিকিৎসায় নতুন সম্ভাবনা
গবেষণাটি কেবল প্রকৃতির রহস্য উন্মোচনেই সীমাবদ্ধ নয়, এটি চিকিৎসা বিজ্ঞানের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। ইন্ডিয়ানা ইউনিভার্সিটির গবেষক লুয়ানা অ্যাসিস ফেরেইরা বলেন, “বিষ কীভাবে ব্যথার রিসেপ্টরের সঙ্গে কাজ করে, তা বোঝা গেলে ব্যথানাশক ওষুধ তৈরিতে সহায়তা করা সম্ভব।” ভেলভেট পিঁপড়ার বিষ নির্দিষ্ট ব্যথার স্নায়ুকে লক্ষ্য করে, যা মানুষের জন্য নতুন ধরনের ব্যথা উপশমকারী ওষুধের পথ দেখাতে পারে।
প্রকৃতির শিক্ষা
গবেষকরা মনে করেন, ভেলভেট পিঁপড়ার এই বিস্ময়কর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা প্রকৃতির অভিযোজনের একটি চমৎকার নমুনা। এটি প্রমাণ করে যে, প্রকৃতিতে লুকিয়ে থাকা রহস্য উন্মোচন করলে বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির নতুন দিগন্ত খুলে যেতে পারে। এই গবেষণা কেবল পিঁপড়ার হুলের যন্ত্রণার কারণ ব্যাখ্যা করেনি, বরং ভবিষ্যৎ চিকিৎসা গবেষণার জন্য একটি সম্ভাবনাময় পথও তৈরি করেছে।