বিক্ষোভে উত্তাল তুরস্ক, প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের পদত্যাগ দাবি

তুরস্কের জনপ্রিয় রাজনীতিবিদ ও ইস্তানবুলের মেয়র একরেম ইমামোলুর গ্রেফতারের প্রতিবাদে দেশজুড়ে তীব্র আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে। প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের কঠোর নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ চালিয়ে যাচ্ছেন। এই আন্দোলনের এক পর্যায়ে এরদোয়ানের পদত্যাগের দাবি উঠেছে, যা দেশটির রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে আরও উত্তপ্ত করে তুলেছে।
গত বুধবার (১৯ মার্চ) দুর্নীতি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে ইমামোলুসহ বেশ কয়েকজন বিরোধী নেতাকে গ্রেফতার করে তুরস্কের পুলিশ। এর পরপরই রাজধানী ইস্তানবুল থেকে শুরু হওয়া বিক্ষোভ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে। অনেকে এই ঘটনাকে ২০১৩ সালের গেজি পার্ক আন্দোলনের পর দেশটির সবচেয়ে বড় সরকারবিরোধী আন্দোলন হিসেবে অভিহিত করেছেন। সে সময়ের আন্দোলনে অন্তত আটজন প্রাণ হারিয়েছিলেন।
বিক্ষোভ দমনে কঠোর পদক্ষেপ
বিক্ষ Bোভ নিয়ন্ত্রণে ইস্তানবুলের গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়া শহরগুলোতে পাঁচ দিনের জন্য সব ধরনের জমায়েত নিষিদ্ধ করেছে প্রশাসন। বৃহস্পতিবার আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে সহিংসতার কারণে একটি মেট্রো স্টেশনও বন্ধ করা হয়। শুক্রবার ইস্তানবুলে পুলিশ বিক্ষোভকারীদের ওপর পেপার স্প্রে, কাঁদানে গ্যাস ও রাবার বুলেট ব্যবহার করে, জানিয়েছে বার্তা সংস্থা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস (এপি)। আঙ্কারা ও ইজমিরে পুলিশের বলপ্রয়োগে বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করা হয়। আঙ্কারায় শিক্ষার্থীরা একটি প্রধান সড়কে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করলে কাঁদানে গ্যাস ছোড়া হয়।
এরদোয়ানের হুমকি ও প্রশাসনের কঠোরতা উপেক্ষা করে বিক্ষোভকারীরা আন্দোলন অব্যাহত রেখেছেন। বিক্ষোভে এরদোয়ানের শাসনকে ফ্যাসিবাদের সঙ্গে তুলনা করে স্লোগান দেওয়া হয়েছে এবং তার পদত্যাগের দাবি উঠেছে। দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলি ইয়ারলিকায়া জানিয়েছেন, সারা দেশে অভিযান চালিয়ে ৯৭ জন বিক্ষোভকারীকে আটক করা হয়েছে।
আন্দোলনের পটভূমি
তুরস্কের অর্থনীতি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ক্রমশ অবনতির দিকে যাচ্ছে। মূল্যস্ফীতি, মুদ্রার অবমূল্যায়ন ও জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির কারণে নাগরিকদের মধ্যে অসন্তোষ বাড়ছে। মিডলইস্ট আইয়ের এক জরিপে বলা হয়েছে, ১৮-২৫ বছর বয়সীদের দুই-তৃতীয়াংশ সুযোগ পেলে দেশ ছাড়তে চায়। এই অস্থিরতার মধ্যে ইমামোলুর গ্রেফতার রাজনৈতিক উত্তেজনাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, তিনি জনগণের জন্য আশার প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন, এবং তার গ্রেফতারে সংসদীয় গণতন্ত্রের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
বিরোধীদের ওপর চাপ
সমালোচকরা অভিযোগ করেছেন, ২০২৮ সালের নির্বাচনকে সামনে রেখে এরদোয়ান প্রশাসন বিরোধী নেতাদের দমন করছে। রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা আনাদোলু জানিয়েছে, ইমামোলুসহ ১০০ জনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছে। তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী মুরাত অনগুনও আটকদের মধ্যে রয়েছেন। ইমামোলুকে নির্বাচনে প্রার্থী হতে বাধা দিতে তার বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদও বাতিল করা হয়েছে, যা তুরস্কের আইনে প্রার্থী হওয়ার জন্য বাধ্যতামূলক।
২০১৯ সালে ইমামোলু ইস্তানবুলের মেয়র নির্বাচিত হন। প্রথম নির্বাচনে জয়ের পর এরদোয়ানের দল অভিযোগ তুলে ফের নির্বাচনের দাবি জানায়। কিন্তু দ্বিতীয় দফায় আরও বড় ব্যবধানে জয়ী হন তিনি। এরপর থেকে তাকে নানা রাজনৈতিক চাপের মুখে পড়তে হয়েছে।
ইস্তানবুল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংহতি সংগঠনের এক মুখপাত্র বলেন, “ইমামোলুর গ্রেফতার ও সনদ বাতিল গণতন্ত্রের ওপর সরাসরি আঘাত।” তবে প্রশাসন এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছে, আদালত সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে কাজ করছে।
এরদোয়ানের কঠোর অবস্থান
দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে তুরস্ক শাসন করা এরদোয়ান বলেছেন, “দুর্নীতি ও জালিয়াতির বিরুদ্ধে অভিযানকে কেন্দ্র করে বিক্ষোভ বরদাশত করা হবে না।” তিনি বিরোধীদের দায়িত্বজ্ঞানহীন আখ্যা দিয়ে আন্দোলন কঠোরভাবে দমনের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।
প্রধান বিরোধী দল রিপাবলিকান পিপলস পার্টির (সিএইচপি) নেতা ওজগুর ওজেল শুক্রবার শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভের আহ্বান জানান। তিনি অভিযোগ করেন, “নির্বাচনে হারতে না পেরে এরদোয়ান আদালতকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছেন।” রোববার দলীয় প্রাথমিক নির্বাচনে ইমামোলুকে প্রার্থী হিসেবে মনোনীত করার পরিকল্পনা অব্যাহত থাকবে বলেও জানান তিনি।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
বিশ্লেষকরা মনে করেন, ইমামোলুকে সন্ত্রাসী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ততার অভিযোগে মেয়র পদ থেকে সরিয়ে ট্রাস্টি নিয়োগের পরিকল্পনা থাকতে পারে। এমন পদক্ষেপের জবাবে ওজেল ৬ এপ্রিল একটি বাহ্যিক কংগ্রেস ঘোষণার কথা বলেছেন।
ইমামোলুকে শনিবার আদালতে হাজির করা হবে। জুমহুরিয়েত পত্রিকার খবরে বলা হয়েছে, পুলিশ তাকে চার ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করেছে এবং তিনি সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তুরস্কের এই আন্দোলন কোন দিকে যাবে, সেদিকে নজর রাখছে বিশ্ব।
সূত্র: এপি/ইউএনবি