
এক দশক আগেও যে প্রাণীর অস্তিত্ব নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছিল, হিমালয়ের সেই অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সদস্য, হিমালয়ান স্যালাম্যান্ডার বা হিমালয়ান নিউট, এখন পাহাড়ের কোলে দ্রুত বংশবৃদ্ধি করছে। নগরায়ণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আইইউসিএন-এর লাল তালিকার ‘বিপন্নপ্রায়’ শ্রেণিতে স্থান পাওয়া এই উভচরকে বিলুপ্তির হাত থেকে বাঁচাতে রাজ্য বন দফতরের বছরব্যাপী উদ্যোগ অবশেষে সফল হয়েছে। দার্জিলিং ও কার্শিয়াং বন বিভাগের নিরন্তর প্রচেষ্টা এবং স্থানীয় মানুষের সচেতনতা এই সাফল্যের নেপথ্যে মূল কারণ।
বিপন্ন প্রজাতি থেকে পুনরুত্থান
হিমালয় পর্বতমালায় জীববৈচিত্র্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই সদস্য, যার গাঢ় খয়েরি বা হালকা কমলা শরীর সহজেই নজর কাড়ে। জলাশয় এবং স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ এদের আদর্শ বাসস্থান। ১৯৮৫ সালে দার্জিলিংয়ের সুখিয়াপোখরি, জোড়পোখরিতে স্যালাম্যান্ডার অভয়ারণ্য তৈরির একটি সরকারি প্রকল্প নেওয়া হলেও তা শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি। তবে হাল ছাড়েনি বন দফতর। কার্শিয়াং বন বিভাগের উদ্যোগে জলাভূমি সংরক্ষণ, উপযুক্ত ঘাস লাগানো এবং পরিবেশ অনুকূল করে তোলার মতো বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়। এর ফলস্বরূপ, বর্তমানে পাহাড়ের বিভিন্ন অঞ্চলে এই বিরল উভচরের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বন দফতরের তথ্য অনুযায়ী, লাটপাঞ্চারের নামথিং পোখরি এবং কার্শিয়াংয়ের পাঁচপোখরিতে এই প্রাণীর দেখা মিলছে সবচেয়ে বেশি। কার্শিয়াংয়ের বাগোরা রেঞ্জের সংরক্ষিত এলাকা পোখরিয়াটারেও বিপুল সংখ্যায় এদের উপস্থিতি বন দফতরকে উচ্ছ্বসিত করেছে। কার্শিয়াং ছাড়াও পাঁচপোখরি, দেওরালি এলাকার প্রাকৃতিক পরিবেশও এখন এদের পছন্দের বাসস্থান হয়ে উঠেছে।
স্থানীয় সচেতনতা ও বাস্তুতন্ত্রে ভূমিকা
হিমালয়ান স্যালাম্যান্ডার সংরক্ষণে স্থানীয় পাহাড়বাসীদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। বন বিভাগের লাগাতার সচেতনতামূলক প্রচারে স্থানীয় মানুষ এখন এই উভচরকে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে রক্ষা করছেন। মেরে ফেলা তো দূরের কথা, এদের বিরক্ত করা বা হাতে নিলে স্থানীয়রা রীতিমতো আপত্তি জানান, যা পরিবেশ সংরক্ষণে জনসচেতনতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
পরিবেশবিদরা মনে করেন, কোনো এলাকার জীববৈচিত্র্য ও বাস্তুতন্ত্র কতটা সুস্থ, তা স্যালাম্যান্ডারের উপস্থিতি দেখে বোঝা যায়। এই উভচর যেমন বিভিন্ন কীটপতঙ্গ খেয়ে প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করে, তেমনই সরীসৃপ ও অন্যান্য প্রাণীর খাদ্য হিসেবেও এরা গুরুত্বপূর্ণ। সয়েল ফর্মেশন বা মাটির গঠনের ক্ষেত্রেও এদের গুরুত্ব রয়েছে। তাই পরিবেশপ্রেমীরা স্যালাম্যান্ডারকে বাস্তুতন্ত্রের ‘ইনডিকেটর স্পিসিস’ বা নির্দেশক প্রজাতি হিসেবে দেখেন।
সলিটরি নেচার অ্যান্ড অ্যানিম্যাল প্রোটেকশনের সম্পাদক কৌস্তভ চৌধুরী জানান, “কার্শিয়াংয়ের বাগোরা রেঞ্জ ছাড়াও সুখিয়াপোখরি, টুং এলাকার চা বাগান এবং মিরিকেও স্যালাম্যান্ডারের দেখা মেলে। বর্ষা এদের প্রজননের ঋতু হওয়ায় এখন এদের উপস্থিতি বেশি দেখা যাচ্ছে, যা বাস্তুতন্ত্রের জন্য খুবই ভালো।”
প্রজনন ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
বিশ্ব উষ্ণায়ন এবং জলাশয় ধ্বংসের ফলে একসময় এই উভচরের সংখ্যা অনেকটাই কমে গিয়েছিল। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দার্জিলিংয়ের পদ্মজা নাইডু হিমালয়ান জুলজিকাল পার্কে একটি বিশেষ টেরারিয়াম তৈরি করে এদের প্রজননের উদ্যোগ নেওয়া হয়, যেখানে সফলভাবে বংশবৃদ্ধি ঘটছে।
কার্শিয়াং বন বিভাগের ডিএফও দেবেশ পাণ্ডে বলেন, “স্যালাম্যান্ডারকে আমরা মূলত ইন্ডিকেটর প্রজাতির প্রাণী হিসেবে চিনে থাকি। এই প্রাণী কোথাও থাকা মানে সেখানকার জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ ভালো রয়েছে। আবার এদের বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া মানে পরিবেশে কোনোভাবে বিরূপ প্রভাব পড়ছে। সেজন্য বন দফতরের তরফে এদের সংরক্ষণে একাধিক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আগামীতে যেখানে এদের দেখা মেলে সেইসব জায়গাগুলোকে চিহ্নিত করে সংরক্ষণের পাশাপাশি সেসব জায়গাগুলোকে তাদের স্যাংচুয়ারি তৈরি করা হবে।”
হিমালয়ান স্যালাম্যান্ডারের এই প্রত্যাশিত প্রত্যাবর্তন হিমালয়ের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে এক নতুন আশার আলো দেখাচ্ছে এবং প্রকৃতি ও মানুষের সহাবস্থানের এক সফল গল্প তুলে ধরছে।