
জম্মু ও কাশ্মীরের পর্যটন দপ্তর এবারের গ্রীষ্মকালকে দশকের সেরা হিসেবে আশা করেছিল। সেই মতো প্রস্তুতিও তুঙ্গে ছিল। নতুন সরকারি প্রকল্প, আকাশপথে উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং বছরের শুরু থেকেই অনলাইন বুকিংয়ে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা – সবকিছু মিলিয়ে পর্যটনের চাকা দ্রুত গতিতে ঘোরার ক্ষেত্র প্রস্তুত ছিল। কিন্তু গত ২২ এপ্রিল পহেলগামের বৈসরনে সন্ত্রাসবাদী হামলায় ২৬ জনের মর্মান্তিক মৃত্যু কাশ্মীরের সেই স্বপ্নকে রক্তাক্ত করে দিল ফের। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে নিন্দা, শোক এবং তার প্রত্যাঘাতের প্রস্তুতিতে পর্যটন রাতারাতি অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ল।
হামলার মাত্র সপ্তাহদুয়েক পরেই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের ‘অপারেশন সিঁদুর’ শুরু হয়, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে। কাশ্মীরের সীমান্তবর্তী গ্রামগুলি থেকে স্থানীয় বাসিন্দারাও নিরাপত্তার খোঁজে অন্যত্র চলে যান। এই পরিস্থিতিতে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে – পর্যটকরা কোথায় যাবেন, কেনই বা যাবেন? আর মুহাম্মদ ইসমাইল, আজহার হাবিবের মতো যাঁরা ট্যুরিজ়মের উপর নির্ভর করে সংসার চালান, তাঁরা আচমকাই হলেন বেকার এবং ঋণের ভারে জর্জরিত। অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ তাঁদের জীবনের দিক নির্দেশ করতে পারছে না।
শ্রীনগরের কাছে সাইফা কাদালে থাকেন ৪২ বছর বয়সী মুহাম্মদ ইসমাইল। ঘরে তাঁর তিন শিশু সন্তান। সারা জীবনের সঞ্চয়ের সঙ্গে ৮ লক্ষ টাকা ঋণ নিয়ে তিনি মাস দুয়েক আগে একটি নতুন ট্যুরিস্ট ট্যাক্সি কিনেছিলেন। সেই সাদা এসইউভিটি এখন বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে ধুলো খাচ্ছে। গাড়ির স্তব্ধ চাকার দিকে তাকিয়ে ইসমাইল বলেন, “ভাবি, ওটা কিনে কি জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল করলাম! ব্যাঙ্ক তো দুর্ঘটনা বোঝে না। মাসে ৪৫ হাজার ইএমআই ওদের দিতেই হবে। আর আমি দৈনন্দিনের চাল–ডালই কিনতে পারছি না। ওটা কী ভাবে দেবো!”
২৮ বছরের আজহার হাবিব শ্রীনগরের একটি নামজাদা ট্র্যাভেল এজেন্সিতে গাড়ি চালাতেন। এখন তিনিও বেকার। তাঁর বস স্পষ্ট বলে দিয়েছেন, “ট্যুরিস্ট না এলে ট্রিপ হবে না, ট্রিপ না হলে স্যালারিও পাবে না।” মাসে ১২ হাজার টাকা বেতনের সঙ্গে টিপস মিলিয়ে তাঁর রোজগার ভালোই ছিল, যা দিয়ে তিনি সসম্মানে জীবন কাটাতেন। এখন বুলেভার্ড রোডে অন্য ড্রাইভারদের সঙ্গে চায়ের দোকানে বসে হতাশা ভাগ করে নেন। আজহারের কথায়, “মেয়েটার এখনও চোখ ফোটেনি। ওর জন্য দুধ কিনতে হলেও বন্ধুদের থেকে ৫০ টাকা ধার করতে হচ্ছে।”
রাজ্যের পর্যটনে পহেলগাম হামলা কতখানি প্রভাব ফেলেছে, তার একটি আন্দাজ পাওয়া যায় ট্যুরিজ়ম ডিপার্টমেন্টের এক সিনিয়র অফিসারের কথায়। তিনি জানাচ্ছেন, হামলার পর ৭০ শতাংশের বেশি পর্যটক তাঁদের ট্যুর বাতিল করে দিয়েছেন। গুজরাট, মহারাষ্ট্র, তামিলনাড়ু সহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা সমস্ত গ্রুপ বুকিং বাতিল হয়ে গেছে। ওই অফিসার বলেন, “এ ধরনের ভয়াবহ ঘটনায় এক রকম সাইকোলজিক্যাল প্রভাব পড়ে। বিশেষত প্রথম বার যাঁরা আসছেন, তাঁরা খুব ধাক্কা খান। নতুন করে কোনও বুকিংও হচ্ছে না।”
শুধু ড্রাইভাররাই নন, হোটেল মালিক, গাইড, শিকারা চালক, পহেলগাম ও গুলমার্গের টাট্টুওয়ালা থেকে শ্রীনগরের ডাল লেকের হাউসবোট মালিকরাও এই মুহূর্তে চরম ক্ষতিগ্রস্ত। মে মাসের গরম থেকে নিস্তার পেতে যে পর্যটকরা এই সময়ে কাশ্মীরে ভিড় করতেন, যাঁদের হইচইয়ের রোল উঠত ডাল লেকের জলে, সেখানে এখন বিরাজ করছে অস্বস্তিকর নীরবতা। ফাঁকা নৌকোগুলোর লম্বা সারি থেকে ভেসে আসে কর্মহীন মানুষের দীর্ঘশ্বাস। শিকারার প্যাডলে কেউ চাপ দেয় না, বৈঠাগুলোও পড়ে আছে একদিকে কাত হয়ে।
প্রবীণ গাইড মহম্মদ শাফি গত বহু বছর ধরে পর্যটকদের উপত্যকায় ঘুরিয়েছেন। তাঁর মতে, এখনকার অবস্থা প্যানডেমিকের দুর্দশাকেও ছাপিয়ে গিয়েছে। এর কারণ ব্যাখ্যা করে শাফি বলেন, “তখন তবু সরকারি সাহায্য, ঋণে কিছু ছাড় মিলেছিল। এখন কোনও রিলিফ নেই, ছাড় নেই, সরকারি পরিকল্পনাও নেই।”
এই পরিস্থিতিতে রাজ্য সরকারের কাছে অন্তত ড্রাইভারদের জন্য একটি বিশেষ রিলিফ প্যাকেজ ঘোষণার আবেদন জানাচ্ছে বিভিন্ন সংগঠন। কাশ্মীর ট্যুরিস্ট ট্রান্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (কেটিটিএ)–এর প্রেসিডেন্ট নাজ়ির আহমেদ বলেন, “ঋণের সুদ মকুব, আপাতত কিস্তিতে ছাড় এবং জরুরি ভিত্তিতে ক্যাশ সাপোর্টের জন্য সরকারের কাছে আবেদন জানাচ্ছি। দ্রুত পদক্ষেপ করা না হলে এই ড্রাইভাররা দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর হতে থাকবেন।”
পাশাপাশি, পর্যটকদের ভরসা ফেরাতে যানবাহনের স্বাস্থ্য এবং চালকদের সুস্থতার উপর সরকারের নজর দেওয়া দরকার বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রান্সপোর্ট সেফটি এক্সপার্ট, অধ্যাপক হিলাল আন্দরাবি বলেন, “এখানকার পরিবহণের ফিটনেস এবং চালকদের ক্লান্তির দিকে যে সে ভাবে নজর দেওয়া হয় না, ওই ঘটনা তা–ও দেখিয়েছে। ট্যুরিজ়ম ভেহিকলের অডিট, জিপিএস ট্র্যাকিং ও জরুরি পরিস্থিতির জন্য চালকদের প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করতে হবে।”
পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে সরকার কী পদক্ষেপ করবে বা করবে না, তার উত্তর হয়তো আগামী দিনে পাওয়া যাবে। কিন্তু তার আগে কাটানো প্রতিটা দিনই ইসমাইল, আজহারদের মতো পর্যটন শিল্পের সঙ্গে যুক্ত হাজার হাজার মানুষকে আরও বেশি করে অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। তাই হয়তো ধুলোমাখা এসইউভি–র দিকে তাকিয়ে ইসমাইল বলেন, “যে কোনও দুর্ভাগ্যজনক ঘটনায় প্রথমেই যে ক্ষতিগ্রস্তদের দেখা যায়, তাঁদের বাইরেও অনেকে প্রভাবিত হন। আমরা হলাম সেই অভিশপ্ত ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত এমনই মানুষ, যাদের কথা মনে রাখার প্রয়োজন নেই কারও। বাঁচলাম, কি মরলাম, তাতে কার কী এসে যায়…!”