
সামনেই রথযাত্রা, আর এই ঐতিহ্যবাহী উৎসবকে ঘিরে রীতিমতো উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে বাংলার রাজনীতি। রথ মেলার উর্দুতে বিজ্ঞপ্তি, মালদার শতাব্দী প্রাচীন মেলা বন্ধের অভিযোগ এবং দিঘার রথযাত্রায় ‘হালাল মিষ্টি’ বিতরণের অভিযোগ তুলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারের বিরুদ্ধে ‘জেহাদি তোষণ’ ও ‘উর্দুকরণের’ মারাত্মক অভিযোগ এনেছে বিজেপি ও হিন্দু সংগঠনগুলো।
সম্প্রতি সমাজ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একটি পোস্টারকে কেন্দ্র করে বিতর্কের সূত্রপাত। ওই পোস্টারে রথ মেলার বিজ্ঞপ্তি উর্দুতে লেখা দেখা যাচ্ছে, যা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বিজেপি। তাদের দাবি, রথযাত্রার মতো একটি হিন্দু উৎসবের বিজ্ঞপ্তি কেন উর্দুতে লেখা হবে? এটি হিন্দু সংস্কৃতির প্রতি অবমাননা বলে তাদের অভিযোগ।
মালদা জেলার কালিয়াচক থানার জালালপুর গ্রামে শ্রী মহাপ্রভু মন্দির সংলগ্ন ৬২৯ বছরের ঐতিহ্যবাহী রথযাত্রা মেলা এবার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। উৎসব কমিটির সম্পাদক গৌতম মণ্ডল জানান, পুলিশ আইনশৃঙ্খলার কারণ দেখিয়ে মেলার অনুমতি দিচ্ছে না, যা তাদের সংস্কৃতির উপর আঘাত। বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার এই ঘটনাকে ‘ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র’ আখ্যা দিয়ে বলেছেন, “মোঘলরাও এই মেলা বন্ধ করতে পারেনি। কিন্তু মমতা সরকার হিন্দু সংস্কৃতির উপর কোপ বসিয়েছে।” বিজেপির এক্স হ্যান্ডেল থেকে করা পোস্টে ‘জেহাদি তোষণ’ ও ‘হিন্দু সংস্কৃতিতে কোপ’-এর অভিযোগ তোলা হয়েছে।
বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী রথযাত্রার প্রসাদে ‘হালাল মিষ্টি’ বিতরণের অভিযোগ তুলেছেন, যা হিন্দু ভক্তদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানছে বলে তাঁর দাবি। এই অভিযোগ রাজনৈতিক মহলে তীব্র বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।
অন্যদিকে, দিঘায় নবনির্মিত জগন্নাথ মন্দিরে এই প্রথম রথযাত্রার আয়োজন হচ্ছে, যেখানে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অংশ নিতে পারেন। তৃণমূল সূত্রে জানা গেছে, কর্মীদের পুরীর পরিবর্তে দিঘায় রথযাত্রায় অংশ নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বিরোধীরা একে ‘হিন্দু-বিরোধী’ ও ‘বাংলা-বিরোধী’ বলে সমালোচনা করে অভিযোগ করছে যে, মমতা দিঘার রথযাত্রাকে রাজনৈতিক মঞ্চ হিসেবে ব্যবহার করে পুরীর ঐতিহ্যকে অবমাননা করছেন।
তৃণমূল নেতা অতীন ঘোষ বিজেপির অভিযোগকে ‘রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র’ বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেন, “জগন্নাথ দেব সর্বত্র বিরাজমান। আমরা দিঘায় রথযাত্রার আয়োজন করছি, এতে কোনো ভুল নেই।” তৃণমূলের দাবি, তারা সকল ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং দিঘার রথযাত্রা সাংস্কৃতিক ঐক্যের প্রতীক। তবে, মালদার রথ মেলা বন্ধের বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো স্পষ্ট ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি।
এক্স (আগে ট্যুইটার)-এ এই ঘটনাগুলি নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। ব্যবহারকারীরা ‘হিন্দু ঐতিহ্য ধ্বংস’ এবং ‘বাংলা ভাষার উপর উর্দুকরণ’ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
রথযাত্রা ঘিরে এই রাজনৈতিক বিতর্ক বাংলার সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় পরিচিতিতে নতুন প্রশ্ন তুলেছে। বিজেপি ও হিন্দু সংগঠনগুলি ‘জেহাদি তোষণ’ ও ‘উর্দুকরণের’ অভিযোগ তুললেও, তৃণমূল নিজেদের সকল ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল প্রমাণ করার চেষ্টা করছে। এই বিতর্ক আগামী দিনে রাজ্যের রাজনৈতিক মেরুকরণকে আরও তীব্র করবে বলেই মনে করা হচ্ছে।
বিশ্লেষণমূলক সংবাদ প্রতিবেদন
ভক্তি না ভোট? বাংলার উৎসবে সাম্প্রদায়িকতার অনুপ্রবেশ ও রাজনৈতিক মেরুকরণের নবদিগন্ত
আর কয়েকটা দিন পরেই রথযাত্রা। জগন্নাথদেবের এই পবিত্র উৎসব এবার বাংলার রাজনীতিতে ধর্মীয় মেরুকরণের এক নতুন অধ্যায় উন্মোচন করেছে। একটি রথ মেলার উর্দুতে লেখা পোস্টার থেকে শুরু করে মালদার শতাব্দী প্রাচীন মেলা বন্ধের অভিযোগ এবং ‘হালাল প্রসাদ’ বিতর্কের মতো বিষয়গুলি তীব্র বাদানুবাদ সৃষ্টি করেছে। প্রশ্ন উঠছে, এ কি কেবলই ধর্মীয় ভাবাবেগের প্রকাশ, নাকি আসন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখে ভোট ব্যাঙ্কের কৌশলী অঙ্ক?
রথ মেলার উর্দুতে লেখা বিজ্ঞাপনের পোস্টারটি কেবল একটি ভাষা বিতর্ক নয়, এটি বিজেপির কাছে ‘সাংস্কৃতিক আগ্রাসন’ এবং ‘উর্দুকরণের’ অভিযোগের একটি প্রতীক হয়ে উঠেছে। বিজেপি ও হিন্দু সংগঠনগুলি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের বিরুদ্ধে সরাসরি হিন্দু সংস্কৃতির বিরুদ্ধে ‘জেহাদি তোষণ’ নীতির অভিযোগ এনেছে। স্বামী বিবেকানন্দ এবং চৈতন্য মহাপ্রভুর বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের উপর আঘাতের যে অভিযোগ বিরোধীরা তুলছে, তা রাজ্যের ধর্মীয় পরিচিতিকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছে।
৬০০ বছরের ঐতিহ্য বনাম ‘আইনশৃঙ্খলা’: মালদার রথ মেলা বন্ধের তাৎপর্য:
মালদার কালিয়াচকের জালালপুর গ্রামের ৬২৯ বছরের প্রাচীন রথ মেলা বন্ধের অভিযোগ এই বিতর্কের আগুনে আরও ঘি ঢেলেছে। উৎসব কমিটির দাবি, পুলিশ ‘আইনশৃঙ্খলা’র কারণ দেখিয়ে অনুমতি দিচ্ছে না। বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদারের মন্তব্য, “মোঘলরাও এই মেলা বন্ধ করতে পারেনি। কিন্তু মমতা সরকার হিন্দু সংস্কৃতির উপর কোপ বসিয়েছে,” এই ঘটনাকে এক বৃহত্তর রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে চিত্রিত করছে। একটি শতাব্দী প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী উৎসবকে হঠাৎ করে বন্ধ করে দেওয়ার প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত, তা যদি আইনশৃঙ্খলার কারণও হয়, তবে তার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে, বিশেষত যখন অন্য ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলিতে প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে বিরোধীদের ভিন্ন অভিযোগ রয়েছে।
‘হালাল মিষ্টি’ এবং দিঘার রথযাত্রা: ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগ:
বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর ‘হালাল মিষ্টি’ বিতরণের অভিযোগটি ধর্মীয় স্পর্শকাতরতাকে সরাসরি কাজে লাগানোর একটি উদাহরণ। ‘জগন্নাথের প্রসাদে হালাল মিষ্টি’ – এই দাবি হিন্দু ভক্তদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগ তুলেছে এবং এটি ‘উর্দুকরণ’ নীতির অংশ বলে বিজেপি প্রচার করছে।
অন্যদিকে, দিঘায় নবনির্মিত জগন্নাথ মন্দিরে মুখ্যমন্ত্রীর সম্ভাব্য উপস্থিতি এবং তৃণমূল কর্মীদের পুরীর পরিবর্তে দিঘায় রথযাত্রায় অংশ নিতে বলার নির্দেশকেও বিরোধীরা ‘হিন্দু-বিরোধী’ এবং ‘বাংলা-বিরোধী’ আখ্যা দিয়েছে। এটিকে দিঘার রথযাত্রাকে রাজনৈতিক মঞ্চ হিসেবে ব্যবহার করার এবং পুরীর ঐতিহ্যকে অবমাননা করার প্রচেষ্টা হিসেবে দেখা হচ্ছে। প্রশাসনের বিশেষ প্রস্তুতি এবং তৃণমূলের ‘বাড়ি বাড়ি প্রসাদ’ পৌঁছে দেওয়ার পরিকল্পনাও বিরোধীদের কাছে ‘ভোটব্যাঙ্ক রাজনীতির’ অংশ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
তৃণমূল অবশ্য সমস্ত অভিযোগ অস্বীকার করে ‘রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র’ বলে অভিহিত করেছে। তাদের দাবি, তারা সকল ধর্মের প্রতি সমান শ্রদ্ধাশীল এবং দিঘার রথযাত্রা সাংস্কৃতিক ঐক্যের প্রতীক। তবে, মালদার মেলা বন্ধের বিষয়ে তাদের নীরবতা বা অস্পষ্ট ব্যাখ্যা বিরোধীদের অভিযোগকে আরও শক্তিশালী করছে।
রথযাত্রা ঘিরে এই তীব্র বিতর্ক বাংলার রাজনীতিতে ধর্মীয় মেরুকরণকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছে। বিজেপি এবং হিন্দু সংগঠনগুলি ‘জেহাদি তোষণ’ এবং ‘উর্দুকরণের’ অভিযোগ তুলে হিন্দু ভোটকে সংহত করার চেষ্টা করছে, অন্যদিকে তৃণমূল নিজেদের ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ এবং ‘সকল ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল’ প্রমাণ করতে চাইছে। এই পরিস্থিতি রাজ্যের সামাজিক সম্প্রীতির উপর কী প্রভাব ফেলবে এবং আগামী দিনে এটি কোন নতুন রাজনৈতিক সমীকরণের জন্ম দেবে, তা দেখার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে রাজনৈতিক মহল। ভক্তি এবং ঐতিহ্যের এই উৎসব কি সত্যিই এবার সম্পূর্ণভাবে রাজনৈতিক খেলার ময়দান হয়ে উঠবে?